নয় মাস পর।
মদিনায় একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হলো। আর দশটা সাধারণ শিশুর মতোই জন্মের পর সে তীব্র চিৎকার করে ঘোষণা দিলো তার পৃথিবীতে আগমনের সংবাদ। কচি হাত-পা নেড়ে অন্যসব নবজাতকের মতোই সে জানান দিলো, তার ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু শিশুটি জানে না, তার মা একজন ব্যভিচারিণী। সে ব্যভিচারের ফসল। তার মায়ের মাথার ওপর ঝুলছে পাথরছোঁড়া মৃত্যুদণ্ড!

শিশুটি এসবের কিছুই জানে না। শিশুদের সবকিছু জানতে নেই। শিশুদের সবকিছু জানাতে নেই। তারা বেহেশতি ফুলের মতো পবিত্রতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে, তাদেরকে পবিত্র রাখতে হয়।

জন্মদাত্রী মা সন্তান জন্ম দিয়ে একবার আকুল নয়নে তাকালো নাড়ীছেঁড়া সন্তানের দিকে। অনেকটা সময় নিয়ে দেখলো। চোখজুড়ানো কমলকান্তি মুখাবয়ব। দু’হাত বাড়িয়ে দিলো কোলে নেয়ার জন্য। পরক্ষনেই গুটিয়ে নিলো হাত।
না, এই পাপহাতে সে ছোঁবে না তার পবিত্র শিশুকে। তার পাপের কালিমা সে লাগাবে না তার সন্তানের শরীরে। মদিনার পুণ্য আলো-বাতাসে সে বড় হোক পুণ্যমানুষের সান্নিধ্যে। তার পাপী স্পর্শ যেনো কোনো প্রভাব না ফেলে তার সন্তানের দেহ-মনে।

জন্মদাত্রী কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলো আঁতুড়ঘর থেকে। মদিনার অলিগলি পার হয়ে পৌঁছলো রাসুলের আঙিনায়। বুকের মধ্যে কান্না আটকে ডাকলেন— ইয়া রাসুলাল্লাহ! পাপিষ্ঠা হাজির! ব্যভিচারিণী উপস্থিত আপনার চরণতলে। আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এখন আমি গর্ভ থেকে মুক্ত। আমার ওপর প্রয়োগ করুন শরিয়তের শাস্তি। শাস্তি দিয়ে পবিত্র করুন আমাকে ও আমার সন্তানকে।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তার সামনে এলেন। বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠলো ভেতরটা। জন্মদাত্রী মাকে প্রবোধ দিলেন, সান্ত্বনা দিলেন। তাকে শান্ত হতে বললেন।

মেয়েটি শান্ত হলে তিনি তাকে বললেন, মেয়ে, যাকে তুমি জন্ম দিয়েছো সে তোমার সন্তান। তোমার গর্ভে তার জন্ম। তোমার গর্ভের কোনো পাপ নেই। তোমার সন্তানেরও কোনো পাপ নেই। যাও, ফিরে যাও। তাকে ভালোভাবে লালন-পালন করতে থাকো। তাকে দুধপান করাও। তোমার বুকের দুধে সে বেড়ে উঠুক। তোমার বুকের দুধে কোনো পাপ নেই। সে যখন দুধপান করা ছেড়ে দিয়ে অন্য খাবার গ্রহণ করতে শিখবে, তার জীবনধারণ করার ক্ষেত্রে তোমার উপর নির্ভরশীল থাকবে না, নিজে নিজে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবে, তখন তুমি আসবে। আর আমি তোমার উপর শরিয়তের বিধান কার্যকর করবো, শাস্তি প্রদান করবো।

মেয়েটি আবার আশায় বুক বাঁধলো। আবার আশাহত হলো। অনুতাপের আগুনে তাকে আবার পুড়তে হবে কতো রাত, কতো দিন- কে জানে!

বাড়ি ফিরে এলো সে। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো তার দুগ্ধপোষ্য সন্তান। বুকে আগলে রাখেন তাকে। মাঝে মাঝে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন মোলায়েম শরীরের শিশুটির দিকে। মায়ের দিকে তাকিয়ে খলবলিয়ে হেসে উঠে সে। যেনো চেষ্টা করে মায়ের চেহারার বিষাদ দূর করতে। মায়ের মুখের বিষাদ তবু সরে না।

***
দিন যায়। মাস যায়।
জন্মদাত্রী মা সন্তানকে দুধপান ছাড়িয়ে অন্যান্য খাবারের দিকে মনোনিবেশ করে। আস্তে আস্তে সে মাকে ছাড়াই এটা-সেটা খেতে শুরু করে। খাওয়ার জন্য নিজের চাহিদা মাকে জানাতে শেখে।

ততোদিনে সব ধরনের আবেগ-অনুরাগ চলে যাওয়ার কথা মায়ের। হুঁশে ফিরে স্বাভাবিক জীবনের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার কথা, জীবনের উপর মমতা জন্ম হওয়ার কথা। কিন্তু না, আখেরাতের ভয়ে সে তখনও ভীত, কোনো পরিবর্তন নেই।
সন্তান প্রসবের আড়াই বছর পর যেখানে সন্তানের স্নেহমায়ায় নিজেকে আরও জড়িয়ে নেওয়ার কথা, তার ভালোবাসায় ডুবে যাওয়ার কথা। যেখানে আদালতে তার অপরাধের কোনো মামলা নেই, নথিপত্র নেই; নেই কোনো তথ্য-প্রমাণ, কোনো সাক্ষী, একটু চাইলেই নিজেকে বাঁচিয়ে নেয়ার সমস্ত উপকরণ বিদ্যমান, সেখানে একমাত্র আখেরাতের শাস্তির ভয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ও জীবনদানে প্রস্তুত সে। উদগ্রীব দুনিয়ার শাস্তি বরণ করে আখেরাতের মুক্তির জন্য।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

[‘সিংহহৃদয়’ গ্রন্থ থেকে]