শেফা আলম নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী গত ১৬ এপ্রিল (২০১৮) উত্তরায় নিজ কলেজের হোস্টেলে আত্মহত্যা করেছে; সংবাদটি অনেকেই পড়ে থাকবেন। যদিও বাংলা ট্রিবিউনসহ অল্প কয়েকটি সংবাদমাধ্যমই সংবাদটি প্রকাশ করেছে, খুব একটা শোরগোল হয়নি এ নিয়ে। পুলিশ এসে ময়নাতদন্ত করে শেফার লাশ তার পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে। শেফাকে তার নিজ গ্রামে কবর দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে শেফার স্মৃতিও তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের মনেও কবরস্থ হয়ে যাবে।

শেফার আত্মহত্যার কারণ খুব নগণ্য। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শেফার সেদিন জীববিজ্ঞান পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা খানিকটা কঠিন হয়েছিল এবং পরীক্ষা দেওয়ার পর শেফার মনে হয়, এই বিষয়ে সে এ-প্লাস পাবে না। কিন্তু শেফা তার পরিবারের কাছে প্রমিজ করেছিল পরীক্ষায় এ-প্লাস পাবে। পরীক্ষা ভালো না হওয়ায় এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়ার শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে শেফা বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ।

আত্মহত্যার আগে সুসাইডাল নোটে লিখে যায় শেফা। যেখানে লেখা– ‘আব্বু, আমি জীবনযুদ্ধে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি, আমার লাশ কফিনে করে বাড়ি নিয়ে যেও। আমি তোমার কাছে প্রমিজ করছিলাম, এ-প্লাস পাবো, আমি পারিনি। আমাকে মাফ করে দিও।’

ব্যস, পরিবেশনের মতো সংবাদ এতটুকুই।

কিন্তু সত্যিই কি এ সংবাদের আবেদন এতটুকুই? এ সংবাদ কি আমাদের সামনে ভয়াবহ এক ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরছে না? এটা কি কেবল একজন শেফা আলমের মৃত্যু? নাকি শেফা আলম তার মৃত্যু দিয়ে আমাদের সামনে সেইসব তরুণ শিক্ষার্থীর যাতনাক্লিষ্ট জীবনের চিত্র তুলে ধরলো, যারা বেঁচে থেকেও মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধ হয়ে আছে? শেফা আলমের জায়গায় যদিও আমরা আমাদের সন্তানকে কখনোই কল্পনা করি না, কিন্তু আমরা কি আমাদের সন্তানের কাছে শেফা আলমের মতোই এ-প্লাসের সোনার হরিণ প্রত্যাশা করি না?

দুই.

আমার ভাগ্নি এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার মেধা তালিকায় আমাদের থানার মধ্যে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছে, ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পেয়েছে। এ নিয়ে আমাদের পরিবারে আনন্দ বিরাজ করেছে গত কিছুদিন। স্কুলের শিক্ষকদের জম্পেশ খানা-খাদ্যের আবদারও পূরণ করা হয়েছে। তারা কষ্ট করে পড়িয়েছেন, সুতরাং তাদের সামান্য আবদার তো রাখতেই হয়।

কিন্তু পরীক্ষার ফলাফলের এই মচ্ছবের মাঝেও আমি আমার ভাগ্নিকে নিয়ে শঙ্কিতবোধ করছি। আজকে সে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছে, ফলে তার মাথার ওপর তার অভিভাবকদের আকাঙ্ক্ষার রাশি রাশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিক সমাপনীতে ভালো করেছে, সুতরাং জেএসসিতে তাকে আরও ভালো করতে হবে, এসএসসিতে আরও ভালো, এইচএসসিতে ভালো এবং অনেক ভালো…। কিন্তু যদি কোনও কারণে সে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করতে না পারে, তখন কী হবে? তার ওপর নেমে আসবে অভিভাবকদের গালমন্দের ঝড়, বন্ধু আর আত্মীয়দের দুয়োধ্বনি— ‘হাজার হাজার টাকা ব্যয় করছি তোমার পেছনে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তোমার পেছনে ছুটছি, তোমার ভালো ফলাফলের জন্য রাত-দিন আমাদের ঘুম নেই, তারপরও ফলাফল এত খারাপ? এই প্রতিদান দিলে তুমি আমাদের? আমাদের স্বপ্ন এভাবে ধূলিসাৎ করে দিলে?’

এমন পরিবার খুব কমই আছে আমাদের সমাজে যেখানে সামান্য খারাপ ফলাফলের পর প্রত্যেকজন শিক্ষার্থীকে এমনতর গালমন্দ শুনতে হয় না। আমরা তাদের বকি, মারি, বাড়ি থেকে বের করে দেই এবং ফলশ্রুতিতে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

২১ এপ্রিল একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বাংলা ভার্সনের সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে, পাশের দেশ ভারতে প্রতি ৫৫ মিনিটে একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শুধু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ২০১৬ সালে ১১০০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এই আত্মহত্যা সংঘটনের ৯০ শতাংশ কারণ, পড়াশোনা নিয়ে মানসিক চাপ, পরিবারের চাপ, ভালো ফলাফল করতে না পারা, ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারা…এসব।

কী ভয়াবহ তথ্য ভাবা যায়! শুধু পড়াশোনার জন্য, ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষার্থীদের অকাতরে জীবন দিতে হচ্ছে। আজ যার ফুলের মতো বিকশিত হওয়ার কথা, সে কুঁড়ি হয়ে ফোটার আগেই ঝরে যাচ্ছে। যার আজ পাখি হয়ে উড়ে বেড়ানোর প্রবল সদিচ্ছা থাকার কথা, সে ডানাভাঙা পাখির মতো ঘরের কোণে ছটফট করে মরছে।

একবার ভাববেন কী, সন্তানের ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’ নির্মাণের জন্য তাকে মানসিক নির্যাতন করার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? কে আপনাকে এই অধিকার দিলো যে আপনার সন্তানের শৈশব-কৈশোরকে হত্যা করার একমাত্র অধিকারী আপনি? অনেক বড় অফিসার হওয়ার জন্য, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য, লাখ টাকা মাইনের চাকরির জন্য তাকে জীবন বাজি রেখে এ-প্লাস পেতে হবে—এই অব্যর্থ ওষুধ খাওয়ানোর অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে?

তাকে তার নিজের জীবনকে ভালোবাসতে শেখান। তাকে পড়াশোনার প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করুন। আপনি বাবা কিংবা মা, আপনার আর সন্তানের সম্পর্ক যেন ‘চোর-পুলিশে’র মতো না হয়। আপনি বাবা কিংবা মা, সন্তান যেন আপনাকে কখনও জল্লাদ মনে না করে।

তিন.

আমাদের স্কুলগুলোর চিত্র দেখুন। সেখানে একজন শিক্ষার্থীর কেবল গ্রেডের বিচার হয়, তার আর কোনও মনোবৃত্তির কোনও মূল্যই নেই সেখানে। একজন শিক্ষার্থীর মন কী পড়তে চায়, কী করতে সে ভালোবাসে, কী কারণে তার মন খারাপ থাকে, কেন সে পাঠকক্ষে মনোযোগী নয়—এসবের কোনও কেয়ারই নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তোমার কাজ হলো, পাঠ্যবই ও সহায়ক গ্রন্থের সকল পড়া মুখস্থ করা এবং পরীক্ষার খাতায় নির্ভুলভাবে তা উগড়ে দেওয়া। এ যেন গুলিস্তানের ঘোড়ার গাড়িতে জুড়ে দেওয়া অবলা টাট্টু ঘোড়া, কাঁধের মধ্যে বইয়ের জোঁয়াল নিয়ে স্কুল-কোচিং-টিউশন-বাসায় নিত্য আসা-যাওয়া।

অমুক স্কুল অনেক নামী স্কুল, কেউ বি-গ্রেড পাবে তো দূরের কথা, জিপিএ-৫ ছাড়া এ স্কুলের কোনও শিক্ষার্থীর পাস করার কথাই চিন্তা করা যায় না। সারা দেশের মধ্যে নামকরা স্কুল, এ স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য যুদ্ধ হয় প্রতিবছর। কিন্তু কত শিক্ষার্থীর শৈশব আর কৈশোরের আত্মবিসর্জনের মাধ্যমে অমুক স্কুলের নাম পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়, সে পরিসংখ্যান কি আপনি কখনও করেছেন? সন্তান ভালো স্কুলে পড়ে, নিশ্চয় সে ভালো ফলাফল করবে—এই চিন্তা একজন শিক্ষার্থীকে সবসময় অসম্ভব মানসিক চাপের মধ্যে রাখে। যদি তার অমনোযোগিতার ফলে কোনোভাবে ফলাফল খারাপ হয়, মা-বাবা অনেক কষ্ট পাবে। বন্ধুদের সামনে মুখ দেখাবে কী করে? শিক্ষকরা কী বলবে? এই দুশ্চিন্তা তাকে তার বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে দেয়। বিশাল আকাশ আর বৃক্ষের কথা কখনও তার মনে পড়ে না। তার মনের মধ্যে সবসময় ঘুরে বেড়ায় ত্রিকোণমিতি, প্যারাগ্রাফ, বাদশাহ বাবর কত সালে পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন?

এটাই কি শিক্ষার সংজ্ঞা? শিক্ষার এই মৌলিক অধিকারের কথাই কি কেতাব-পুস্তকে লেখা আছে? শিক্ষা মানেই ভালো ফলাফল? ভালো ফলাফল মানেই ভালো মাইনের চাকরি, সমাজে সন্তানের বদৌলতে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল ! অথচ পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করতে গিয়ে হয়তো শিক্ষার্থীর নিজের শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে নিকষ অন্ধকারে। সে পরিণত হয়েছে নিপাট এক মানবরোবটে। স্কুল-পরীক্ষা-রেজাল্ট-এই গোলকধাঁধায় ফেঁসে গিয়ে সে কোনোদিন বুঝতেই পারেনি কীভাবে তার খেলাধুলা আর উড়ে বেড়ানোর দিনগুলো হারিয়ে গেছে। এই সন্তান যদি কোনোদিন তার শৈশবের দিনগুলো আপনার আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে বলে, তখন আমরা তাকে কী জবাব দেবো? পাঁচ কেজি সাত কেজি ওজনের ব্যাগ একজন পাঁচ-সাত বছরের শিশুকে বহন করতে হচ্ছে প্রতিদিন। ওটা কি সত্যিই শিক্ষার বোঝা? জ্ঞানের বোঝা? নাকি অভিভাবকদের চাপিয়ে দেওয়া স্বেচ্ছামরণের বোঝা?

একটাবার ওদের বাঁচতে দিন! খোদার দোহাই দিয়ে বলছি, ওদের স্বাভাবিক একটা জীবন নিয়ে বেড়ে উঠতে দিন। অসামান্য রেজাল্ট, নামকরা স্কুল-কলেজে ভর্তি, বিসিএস ক্যাডারের জন্য দিন-রাত গাদা গাদা বইয়ের নিচে মুখ গুঁজে বসে থাকা–এই জীবন থেকে ওদের মুক্তি দিন। এটা স্বাভাবিক জীবন নয়, এটা একটা পরিপূর্ণ অস্বাভাবিক জীবন, একটা মানসিক বন্দিত্বের জীবন।

আপনি বুঝতে পারছেন না, কিন্তু আপনার ছেলেটা হয়তো তার বন্ধুদের সঙ্গ থেকে দূরে থেকে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আপনি স্নেহের সাদা চোখে সেটা ধরতে পারছেন না। সে হয়তো আকাশ দেখতে চায়, বৃষ্টি ধরতে চায়, গান গাইতে চায়, বন্ধুদের সঙ্গে একটু বাইরে বেরোতে চায়–তার এটুকু স্বাধীনতা কেড়ে নেবেন না প্লিজ।

ওদের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখুন, জীবনের সঠিক অর্থটা ওদের বুঝিয়ে বলুন। অনেক টাকা, অনেক সম্মান, বিরাট চাকরি, বিদেশে উচ্চশিক্ষা–এটাই জীবনের শেষকথা নয়। জীবনে সুখী হওয়ার জন্য সামান্য কিছু প্রয়োজন হয়। কিন্তু অহেতুক আমরা তা বিরাট বিভূতির কাছে ভিক্ষা চাই।

মনে রাখবেন, পরাধীনতা দিয়ে আপনি কখনও ভালোবাসা জয় করতে পারবেন না। ভালোবাসার অপর নাম স্বাধীনতা। তাকে স্বাধীনতা দিন, দেখবেন, একদিন সেই আপনাকে ভালোবাসার অপার সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ভালোবাসার চেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র পৃথিবীতে খুব বেশি আবিষ্কার হয়নি আজ পর্যন্ত।

Bangla Tribune-এর সৌজন্যে