আমরা সবার সামনে প্রাণ খুলে হাসতে পারি, কিন্তু সবার সামনে মন খুলে কাঁদতে পারি না কেন? কান্না এলে আমরা চোখের জল লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এদিকে ওদিক তাকিয়ে দেখি- কেউ দেখে ফেললো না তো! কান্না লুকাতে হাসির আশ্রয় নেই। কী অবিচারসুলভ কাজ! হাসি হলো কান্নার চরমতম শত্রু, দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। অথচ হাসি দিয়েই আপনি কান্নাকে আড়াল করতে চাচ্ছেন?

কেন আমরা এমন করি? হাসি এবং কান্না, দুটোই আবেগনির্ভর জিনিস, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। আবার হাসি এবং কান্না- দুটোই কিন্তু প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল। কাউকে হো হো করে হাসতে দেখলে আমাদের মধ্যেও হাসির প্রভাব বিস্তার হয়। ঠোঁট আপনাআপনি দু’দিকে উপরে উঠে যায়।

কান্নাও কিন্তু একই প্রভাবীয় বস্তু। কোনো মৃতবাড়িতে যান, সেখানে মৃতের আত্মীয়-স্বজনের বুকফাটা কান্না দেখে আপনার চোখেও জল চলে আসবে। ঠোঁটের অবস্থান পরিবর্তন হয়ে যাবে।

তাহলে? আমরা যুক্তি দেবো- কান্নাটা হলো মানুষের দুর্বলতা, মানুষ তার দুর্বলতা দেখাতে চায় না। সবাই নিজের দুর্বলতা লুকিয়ে রাখতে চায়। দুর্বলতা মানুষকে দেখিয়ে বেড়ানো কোনে কাজের কথা না।

আচ্ছা! ব্যাপরটির আরেকটা কারণ হতে পারে- হাসলে আমাদের সুন্দর দেখায়, গালে টোল পড়ে, ঠোঁট গোলাপসম দেখা যায়, গালে লালিমা আসে (একোর্ডিং টু কবিগণ)। কিন্তু কান্না করার সময় আমাদের নিচের ঠোঁট বেঁকে ব্যাকাত্যাড়া হয়ে যায়, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে গালের কন্ডিশন খারাপ করে দেয়। অনেক সময় নাক দিয়েও জল গড়ায়। নাকের পানি চোখের পানি মিলেমিশে একাকার। কতো রোমান্টিক একটা দৃশ্য।

আমার কিন্তু কান্না জিনিসটাকে একদম মন্দ লাগে না।

আমার বিবি সাহেবাকে প্রায়ই বলি- প্লিজ, আপনে একটু কাঁদেন না! আমার সামনে বসে একটু কাঁদেন। এখন যদি কান্না না আসে তাহলে যখন কাঁদবেন তখন আমাকে বলবেন, আমি এসে আপনার কান্না দেখবো। কী এক পাষণ্ড কারণে এই মহীয়সী নারী কখনো কাঁদেন না। আমি তাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। আড়ালে বা ঘুমের ঘোরে কাঁদেন কী-না, সে ব্যাপারে অবশ্য জানতে পারিনি।

নারীদের ছিঁচকাঁদুনে বলে সুনাম আছে। কিন্তু এই নারীর ব্যাপারে এমন ‘ছিঁচকাঁদুনে’ তকমা লাগানো তকমার প্রতি অবিচার ছাড়া আর কিছুই না। তার নাম হওয়া উচিত খিঁচকাঁদুনে- কান্না কো জিস নে খিঁচ কর আপনে আন্দর রাখ দিয়া!

যাক, বিবিকেন্দ্রীয় কথা যখন চলেই এলো তখন আরও কিছু বিবীয় কথা বলি। এর মধ্যে আলোচ্যসূচিতে রাখা দুর্বলতার বিষয়টিও থাকছে।

আমাদের সমাজে স্ত্রীকে ভালোবাসাটাও এক ধরনের দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। কেউ যদি স্ত্রীর প্রতি খানিকটা বেশি ভালোবাসা প্রকাশ করে, বা স্ত্রীকে বেশি সময় দেয়, স্ত্রীর কথামতো নানা বদভ্যাস ছেড়ে দিতে চায়… বন্ধু-বান্ধব পাড়া-প্রতিবেশী বলতে থাকে- ওর কি পুরুষত্ব বলতে কিছু আছে নাকি? শালায় একটা বউন্যাওটা, বউয়ের কথায় উঠে বসে! পুরুষমানুষ বউয়ের প্রতি এতো দুর্বল থাকলে দুনিয়া চলে?

কী আজব! বউয়ের কথা শুনলে পুরুষত্ব কীভাবে স্খলিত হয়… এটা নিয়ে মেডিকেল থিসিস হওয়ার দাবি রাখে।

এমন অনেক ছেলের কথা জানি, যারা শুধু পরিবারের সামনে লজ্জার কারণে স্ত্রীকে প্রাণ খুলে ভালোবাসতে পারে না। আরে বাবা… আমি রাত্রীকালীন ভালোবাসার কথা বলছি না। স্ত্রীর সঙ্গে হেসে কথা বলা, একটু খুনসুটি-দুষ্টুমি করা, কখনো সখনো ঝগড়া করা, রাগ-অভিমান করা… পরিবারের বাবা-মা বা ভাই-বোন কেউ দেখলে কী বলবে? সবাই ভাববে- ছেলেটা কেমন! বউয়ের সঙ্গে ব্যাটাছেলের এতো কিসের মাখামাখি?

আমাদের অধিকাংশ পুরুষের বউমান্য নীতি হচ্ছে- বউ হচ্ছে নারীজাতি। তাদেরকে সবসময় আঙ্গুলের ইশারার উপর রাখতে হবে। ঘাড়ের উপর সবসময় পৌরুষের গম্ভীর নজরদারি ঝুলিয়ে রাখতে হবে। ব্লা… ব্লা… ব্লা…

ভাইয়েরা আমার, কাউকে যদি শাস্তিই দিতে চান, কাউকে যদি অঙ্গুলি হেলনে চালাতে চান তবে তাকে দুর্ধর্ষভাবে ভালোবাসেন। ভালোবাসার চাইতে বড় শাস্তি আর হতে পারে না। একবার বউকে দুর্দমনীয়ভাবে ভালোবেসে আপনার প্রেমে পড়তে বাধ্য করুন।

দেখবেন- আপনার অঙ্গুলিও হেলানো লাগবে না, আপনার প্রেমের কারণে সে সারাক্ষণ জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো ছটফট করতে থাকবে- কখন তাকে আপনি কিছু বলবেন। আপনার একটি কথা মান্য করার জন্য সে অধীর হয়ে অপেক্ষা করবে- লোকটা আমাকে আরও দুটো কথা বলে না কেন?

বউকে ভালোবাসাটা দুর্বলতা নয়, দুর্বলতা হচ্ছে- আপনি যদি বউয়ের প্রেমে পড়তে না পারেন। আপনি না পারলে আপনার প্রেমে পড়তে বউয়ের বয়েই গেছে!

আপনার কি কখনো মনে হয়নি, বউকে যে আপনি আমাদের রাসুল মুহাম্মদ সা.-এর মতো ভালোবাসতে পারেননি, এটা আপনারই সবচে বড় দুর্বলতা?

যাকগে, কথা অনেক হয়ে গেলো। তবে কথা কিন্তু আগেরটিই রইলো- সবার সামনে হাসতে পারলে, এখন থেকে আমরা সবার সামনে কাঁদতেও পারবো। কান্নার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। কান্না কোনো দুর্বলতা নয়। কান্নাও একটা প্রবল বিধ্বংসী শক্তি। কাঁদো বাঙালি কাঁদো…!