এটা সম্ভবত ছাপা হওয়া আমার প্রথম লেখা। ২০০৫ কিংবা ০৬ সালের কোনো এক মাসে মাসিক রহমতে ছাপা হয়েছিল। এ লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর আমার একটি মধুর স্মৃতি আছে। 

আমি তখন মাদ্রাসায়ে দারুল উলূম মিরপুর ৬ নম্বর মাদরাসায় কাফিয়া পড়ি সম্ভবত। রহমত পড়ি নিয়তিম। একদিন কী মনে করে সাহস করে লেখাটি মাসিক রহমতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। অবাক করে দিয়ে ছাপাও হয়ে গেল। ঘটনা ঘটল লেখা ছাপা হওয়ার পর।

মিরপুর ৬-এর নাজেমে তালিমাত সাতক্ষীরা হুজুর, মাওলানা আবুল কালাম সাহেব। সহকারী নাজেম মুফতি নজীরুল ইসলাম, বয়সে একেবারেই তরুণ। তো, নজীরুল ইসলাম সাহেব লেখাটা দেখে কীভাবে যেন জেনে গেলেন এটার লেখক আমি। আমার নাম তো সেভাবে লেখক হিসেবে কেউ জানতো না, বন্ধুদের মধ্যে কে যেন বলেছিল হুজুরের কাছে। 

হুজুর কুতুবখানায় ছিলেন তখন, আমাকে ডেকে বললেন, এটা তোর লেখা? 

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, জি হুজুর!

এরপর হুজুর পত্রিকা এবং আমাকে নিয়ে মাদরাসার দফতরে নিয়ে গেলেন। সেখানে সাতক্ষীরা হুজুরসহ আরও কয়েকজন হুজুর ছিলেন, তাদের সামনে আমার ছাপা হওয়া লেখার ঘোষণা দিলেন এবং প্রশংসাও করলেন। নজীরুল ইসলাম সাহেব লেখা চালিয়ে যেতে বললেন, লেখালেখি থামাবি না, চালিয়ে যা।

এরপর সাতক্ষীরা হুজুরও নানা সময় আমাকে নানাভাবে উৎসাহ দিয়েছেন, সাহায্য করেছেন লেখালেখি বিষয়ে। মিরপুর ১১ নম্বরে ‍হুজুরের মসজিদে ডেকে নিয়ে বিভিন্ন বই কপি করার কাজ করাতেন আমাকে দিয়ে, অথবা লেখালেখি বিষয়ের কোনো কাজ। আমার মনে আছে, মাদরাসার দেয়ালিকা হতো তখন। উপরের ক্লাসের ছাত্রদের দেয়ালিকার কাজটা না দিয়ে আমাকে দিতেন। আমি ছোট হওয়া সত্ত্বেও আমার প্রতি হুজুরের এই আপাত্য স্নেহ আজও আমাকে বিনম্র শ্রদ্ধায় নমীত করে। 

এ জীবনে তাদের ঋণ অশোধযোগ্য। বিশেষত নজীরুল ইসলাম সাহেব হুজুর ওইদিন যদি ওভাবে আমাকে সব হুজুরের সামনে এভাবে উৎসাহ না দিয়ে খানিকটা গালমন্দ করতেন কিংবা নিরুৎসাহিত করতেন লেখালেখিতে, তাহলে হয়তো আমার জীবনও অন্যভাবে লেখা হতে পারতো। কিন্তু ওই সামান্য কথাটুকু আমার জীবনের কত বড় ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল, সেটা নজীরুল ইসলাম সাহেব কখনো জানতেও পারবেন না। হুজুরকে সশ্রদ্ধ সালাম। 

মিরপুর ৬ নম্বর থেকে চলে আসার পর সাতক্ষীরা হুজুুরের সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু নজীরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আর সম্ভবত কোথাও দেখা হয়নি। ফর্সা সুদর্শন মানুষটার সঙ্গে জীবনে আরেকবার কোথাও দেখা হোক, এমন তামান্না হররোজ করি!


আমি তারুণ্যের কথা বলি

বলতে বাধা নেই যে আবেগ দিয়ে আগুয়ান হওয়া যায়, অগ্রসর হওয়া যায়। তবে ভবিষ্যৎ পথের পাথেয় তোলা থাকে বেপরোয়ার সিন্দুকে। বাস্তবসিদ্ধ রূঢ় সত্যের সম্মুখ সময়ের মানচিত্র গোটানো থাকে আবেগের তলানীতে। ফলশ্রুতিতে স্লোগান ওঠে, গরম হয় পল্টন, নেতা গলা ফাটানো ধাঁড়ি ধাঁড়ি উত্তপ্ত মিথ্যা আশ্বাস দেয়। আবেগী তারুণ্যে বান ডাকে বিপ্লবের। সেই বান ডাকা আবেগী বিপ্লবের সম্যক উপকরণ দিতে আমাদের স্বপ্নতাড়িত নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন অতীতে, বর্তমানে বলাটাই নিষ্প্রয়োজন। বিপ্লবী তারুণ্য সমাবেশ, র‌্যালি, অবরোধ করে একসময় থিতু হয়ে বসে। আবেগের দৌড় পল্টন পর্যন্ত।

আমাদের বিপ্লবী জীবনে মানগত কিছু পরিবর্তন ব্যতিরেকে এর সুফল খোঁজা দায়। বৈপরীত্য কাম্য নয়। ব্যাপারটা যদিও পুরনো তবুও ভাবনার খোরাক। ইসলামি শিক্ষাদানের বা ইসলামি ভাবধারায় উজ্জীবিত প্রতিটি কিশোরের বুকে ইসলামকে সমুন্নত রাখার যে প্রত্যয় উদয় হয়, বাস্তবতার দর্পণে তার প্রতিফলন আদৌ ঘটে না বা ঘটতে দেয়া হয় না। এই তরুণ বিপ্লবী ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দলের ভাঙ্গন, হীন স্বার্থে রাজনৈতিক ফাটলের দুঃখময় বাস্তব মতাদর্শের যাঁতাকালে পড়ে, চোখ ভরা প্রকট ঘৃণা আর এক বুক হতাশা নিয়ে আবেগী রাজনীতিক জানায় আল-বিদা।

দুঃখটা এখানেই। তারুণ্যের উত্তাল, নির্ভীকতার বাধভাঙ্গা সয়লাব ছাড়া কোনো সত্যাদর্শ ও বিপ্লবই গতি পাবে না। অতীতেও পায়নি। একথা ইতিহাসে স্বীকৃত। সেই তারুণ্যের লালিত স্বপ্নসৌধে যখন নামে অস্বচ্ছ কোন্দলের সন্ধিগ্ধতা, বুকে জমানো কাংখিত মাইলফলক যখন বারবার ভাঙ্গে ক্ষমতলিপ্সু নেতার বালখিল্যতায়; আর লাভ কী বলুন আজন্ম লালিত স্বপ্ন বুকে জমিয়ে রেখে? এ রকম আশাহত তারুণ্যের সংখ্যা অগণিত। অন্তত যারা ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তাদের কয়েক গুণ।

আমি ইসলামি ছাত্র রাজনীতির কথা বলছি। তাকে বিপ্লব, আন্দোলন, জিহাদ, মুভমেন্ট যাই বলুন না কেন, কাহিনি একটাই। লড়াই কিংবা রাজপথে আন্দোলন। লক্ষ্য ইসলামি রাষ্ট্র। যদি তাই হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণসংঘ ব্যতীত ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পিত রূপরেখা ভাবনার অতিরঞ্জিত বিষয়। পল্টনের জনসভায় তপ্ত ইশতেহার যতই রং মেখে ঢং সাজুন না কেন, এ দাবি একক আদর্শগত, লাখো বিশুদ্ধ তরুণ্যের আমরণ সাধ ও স্বপ্ন। নিজ দলের চাটুকারসুলভ মন্ত্রণাদাতাগণ যতই কর্মী সম্মেলন করুক না কেন, তার অধিকাংশই ফ্রি বাসের মাগনা যাত্রী।

সাংগঠনিক দুর্বলতা সমস্যা। তার চেয়েও বড় সমস্যা অনৈক্যের, অহমিকাবোধের। বর্তমানে একক কোনো দল দিয়ে ইসলামি সমাজ গঠন স্বপ্ন বিলাসী। পত্রিকায় ছবি, বিবৃতির ঢং যতই হোক না কেন, ইসলামের ভবিষ্যৎ জয়গান তোলা থাকবে অক্ষমতার শিকেয়।
আমরা চেয়ে আছি অনন্তের পানে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন আধ্যাত্মিক নেতা। সেখানে সামনে এক চিলতে পথ, বড় দুর্গম সে পথ। তারা কি পারবেন একলা চলতে সেই গিরি সংকট?

ইতিহাস কথা কয়। কালের বাঁকে বাঁকে প্রয়োজন নবীনের। কিসরার প্রাসাদ ফলকে তরবারীর ডগা দিয়ে যারা লিখেছিলেন আপন বীরত্বগাথা, প্রয়োজন সেই উদ্যমী দুর্দমনীয় তারুণ্যের। যাদের বিশ্বাসের পরতে পরতে রয়েছে একাত্ববাদের শ্লোক। শুদ্ধ তারুণ্য কি পারবে ভাঙ্গা কেল্লার বুরুজে সত্যের সে নিশান উড়াতে? সময়ই খুলে দেবে তারুণ্যের নিঁদমাথা চোখ। তারুণ্যই হোক উত্তরণের একমাত্র হাতিয়ার।