রাতের মধ্যপ্রহর। বজরা চলছে। হাকালুকি হাওরের উদোম গা কেটে তিরতির করে এগিয়ে যাচ্ছে। মৃদু ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে আছড়ে পড়ছে বজরার গায়ে। হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশিকে মনে হচ্ছে পারদ গলানো টলটলে রুপালি সরোবর।

বজরার সামনের পাটাতনে বসে আছেন বাউল আবদুল করিম। একা। হাতে দোতারা। কোলে রাখা দোতারা ধরেই আছেন, বাজাচ্ছেন না। অনেকক্ষন পরপর দোতারার তার দু-একবার টুংটাং করে বেজে উঠছে, আপনা থেকেই। বাউলের মন দোতারায় নেই। তিনি একমনে তাকিয়ে আছেন জলমগ্ন হাওরের দিকে। হাওরের শেষ আঁচল আকাশের সঙ্গে মিশে আছে। আকাশে দ্বাদশীর বিরাট চাঁদ। জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে আছে হাওরের পুরোটা। রাত হলেও আকাশের ঝিকমিক হাওরের শারদীয় জলরাশিকে কেমন বিহ্বল করে ফেলছে। একদম ফকফক করছে চারদিক। মনে হচ্ছে অলৌকিক দ্যুতি খেলা করছে হাওরের জলের নিচে।

শরতের এমন উথাল পাথাল জ্যোৎস্নায় বাউলের মনে হঠাৎ শূন্যতার জন্ম দিলো। খা খা শূন্যতা এক ধরনের হাহাকারে ভিজিয়ে দিলো তার বুকের ভেতরটা। কেঁপে উঠলো তার ঠোঁট দুটো। হৃদয়ের গভীর থেকে উথলে উঠতে চাইছে বেদনার অগ্নিভ। অনেক কষ্ট করে দমিয়ে রাখছেন। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করছেন। পারছেন না কিছুতেই।

বাউল দোতারা হাতে নিলেন। তার ভেতর থেকে বেদনারা কথা হয়ে উঠে আসতে চাইছে। কষ্টেরা গান হয়ে মুক্তির নেশায় উন্মাতাল হয়ে উঠছে। অদ্ভুত অপার্থিব আবেগ মিশিয়ে তিনি গেয়ে উঠলেন-

কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু

ছেড়ে যাইবা যদি

কেমনে রাখিব তর মন

আমার আপন ঘরে বাঁধি রে বন্ধু

ছেড়ে যাইবা যদি…

তার বেদনা ইথারে স্থির হয়ে ভেসে থাকছে বেশ কিছুক্ষন। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো হাওরজুড়ে।

২.

: কারিম, আর ইউ ক্রায়িং? তুমি কাঁদছো?

বাউল আবদুল করিম গলায় জড়ানো গামছা দিয়ে চোখের জল মুছে ফেললেন। বিলেতি ম্যাডাম ফ্লোরা রডহ্যাম কখন তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, টের পাননি তিনি।

: বসেন ম্যাডাম… বসেন। এই একটু আবেগ আইসা পড়ছিলো আর কি! চাঁদনী রাইত, হাওরের পানি, এই বজরা… মনটা উতলা হইছিলো।

: নো, নো কারিম! আমি বেশ কিছুক্ষন পেছনে দাঁড়িয়ে তোমার গান শুনেছি। আমি দেখেছি তুমি কাঁদছো আর গান গাইছো। তোমার দু চোখ উপচে জল আসছিলো। কেন কাঁদছো কারিম?

বাউল আবদুল করিম কিছু বললেন না, চুপ করে থাকলেন।

: সরলার কথা মনে পড়ছিলো? ভুলতে পারছো না তাকে? কোডন্ট ফরগেট হার?

বাউল চমকে তাকালেন এই বিলেতি সুন্দরীর দিকে?

[বাউল আবদুল করিমের সারাজীবনের আরাধ্য নারী ‘সরলা’, তার প্রিয়তম স্ত্রী আফতাবুন্নেসা। অসম্ভব ভালোবাসতেন তিনি সরলাকে। কিন্তু তাদের যুগলবন্দি জীবন খুব বেশিদিন স্থায়ী ছিলো না। সরলা মারা যান। এই দুঃখ বাউল সারাজীবন ভুলতে পারেননি। তার গানে বারবার উঠে এসেছে সরলার রূপ, প্রেম, বেদনা, যাপিত কষ্টের কথা।শাহজাহান মমতাজকে ভালোবেসে তাজমহল বানিয়েছিলেন, বাউলের সেই সামর্থ্য ছিলো না। তিনি তার গানে অমর করে গেছেন সরলাকে।এখানে গল্পের অংশবিশেষ প্রকাশিত হলো। বাকিটুকু কোথায় প্রকাশ হবে, আমি নিজেও জানি না।]