শুরুতেই একটা গল্প বলে নিই। শোনা গল্প।

এক মাদরাসার নিজস্ব মসজিদের ইমাম সাহেব অনুপস্থিত। কোনো কারণে ছুটিতে আছেন। তার অনুপস্থিতিতে মাদরাসার আরেক শিক্ষক ইমামতির দায়িত্ব পালন করছেন, মানে নিয়মিত নামাজ পড়াচ্ছেন। জোহরের নামাজ পড়ানোর পর অন্তর্বর্তীকালীন ইমাম সাহেব মোনাজাত করছেন- ‘আয় আল্লাহ! আমাদেরকে তুমি হেদায়েত দান করো। এলাকাবাসীকে হেদায়েত দান করো। প্রতিটি ছাত্রকে হেদায়েত দান করো। প্রিন্সিপাল সাহেবের হেদায়েত দান করো! প্রিন্সিপাল সাহেবের নেক হায়াত দরাজ করো…!’

মাদরাসার প্রিন্সিপাল সাহেব ইমাম সাহেবের পেছনের কাতারেই ছিলেন। ইমাম-শিক্ষকের এমন মোনাজাত শুনে তিনি দারুণ গোস্বা করে উঠলেন। নামাজের শেষে ওই শিক্ষককে দফতরে ডেকে পাঠালেন। রাগতস্বরে জিজ্ঞেস করলেন- ‘আমার হেদায়েত চাওয়া মানে কী? আমার হেদায়েত কেন চাইলেন? আমি কি হেদায়েতের ওপর নাই? আমি কি গোমরাহ? নিশ্চিত আপনার মনে শয়তানি আছে…! এমন শয়তানি হুজুর আমার দরকার নাই!’

ফলশ্রুতিতে ওই শিক্ষকের চাকরি নট! ওইদিনই মাদরাসা থেকে বিদায়!!

 

০২

কওমি মাদরাসার শিক্ষকতা বড় আজিব এক চাকরি। এ চাকরির জন্য কোনো সনদ-সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয় না। শিক্ষকতার কোনো ডকুমেন্টশনেরও প্রয়োজন হয় না। কোনো মাদরাসায় শিক্ষক প্রয়োজন হলে মাদরাসার প্রিন্সিপাল বা অন্য শিক্ষকগণ পরিচিতজনদের মাঝ থেকে একজনকে নিয়োগের জন্য নিয়ে আসেন। ওই শিক্ষকের জ্ঞান-গরিমা, আদব-কেতা  প্রিন্সিপাল সাহেবের পছন্দ হলে তাকে নিয়োগ দিয়ে দেয়া হয়। কোনা অ্যাপয়নমেন্ট লেটার বা নিয়োগবিধির বালাই নেই। কতোদিন চাকরি করবেন বা কী কারণে চাকরি চলে যেতে পারে, এসব ব্যাপারেও লেখাজোখা কোনো বিধি নেই। শিক্ষক নিয়োগও যেমন চলে বিধিহীন, শিক্ষক ছাটাও চলে প্রিন্সিপালের মর্জিমাফিক।

অধিকাংশ মাদরাসায়ই দেখা যায়, প্রিন্সিপাল সাহেবের ছেলে, মেয়ের জামাই, ভাতিজা, ভাগ্নে বা পরিচিতজনরা অকুণ্ঠচিত্তে মাদরাসার শিক্ষকতার পদ বাগিয়ে বসে আছেন। তাদের ব্যাপারে যোগ্যতার প্রশ্ন পরে, নিজের প্রিন্সিপালিত্ব সুদৃঢ় করাটাই মুখ্য বিষয়। প্রিন্সিপাল সাহেবের পদের জোরে তিনি যাকে ইচ্ছা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন, যাকে ইচ্ছা ছাটাই করতে পারেন। এ ব্যাপারে মজলিসে শুরা তো দূরের কথা, অনেক সময় মাদরাসার অন্যান্য শিক্ষকদেরও মতামত নেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশের কোনো কওমি মাদরাসায়ই সম্ভবত নিয়োগের ব্যাপারে কোনো লিখিত কানুন নেই। দু-একটা মাদরাসায় থাকতে পারে, তবে সামগ্রিকভাবে কোনো বিধি নেই।

একজন শিক্ষক পাঁচ বছর একটা মাদরাসায় শিক্ষকতা করলেন। হঠাৎ একদিন প্রিন্সিপাল সাহেবের সঙ্গে কোনো কারণে মতদ্বৈততা হলো, বা প্রিন্সিপাল সাহেবের সঙ্গে কোনো বেয়াদবি হয়ে গেলো, ব্যস! একদিনের নোটিসে তাকে বরখাস্ত! এজন্য কারো কাছে কোনো জবাবদিহিতারও প্রয়োজন পড়ে না। তার জায়গায় দুদিনের নোটিসে আবার নতুন আরেক শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন।

পাঁচ বছর বা দশ বছর একটা মাদরাসায় শিক্ষকতা করার পর একজন শিক্ষক যখন চলে যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কয়েক মাসের বেতন বাকি থাকে মাদরাসার হিসাবের খাতায়। সে বেতন আর ইহজনমে তার পক্ষে উসুল করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া মাদরাসায় কোনো ধরনের পেনশন বা গ্র্যাচুইটির তো প্রশ্নই আসে না। এ শিক্ষককে তখন নতুন আরেকটি চাকরির আশায় ঘুরে মরতে হয়।

আবার শিক্ষকদেরও এমন স্বভাব হয়ে গেছে। তারাও এক হাজার টাকা বেতন বেশি পাওয়ার অফার পেলে বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বেশি পেলে হুড়হুড় করে আরেক মাদরাসায় চলে যান। কখনো শিক্ষাবর্ষের মাঝখানে, কখনো শিক্ষাবর্ষ শেষ করে। আরেক মাদরাসায় গেলে যেহেতু তার কোনো ট্রান্সফার সার্টিফিকেট লাগে না, চারিত্রিক সনদ লাগে না, সুতরাং কে ছাড়ে এমন সুযোগ!

মাদরাসাগুলোতে আরেক ধরনের নিয়োগ চলে। সেটা হলো মুরব্বিকেন্দ্রিক নিয়োগ। বড় মাদরাসার প্রিন্সিপাল বা শায়খের স্নেহছায়ায় পরিচালিত হয় অনেক মাদরাসা। এসব মাদরাসার নিয়োগের ব্যাপারে ওই প্রিন্সিপাল বা শায়খের কথাই শিরোধার‌্য। শায়খ যাকে শিক্ষক হিসেবে পাঠাবেন তাকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এ ব্যাপারে ওই শিক্ষকেরও বলার কিছু থাকে না। কারণ শায়খের কথার বরখেলাফ করা গোনাহ। আবার ওই মাদরাসা কর্তৃপক্ষেরও দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। কেননা তারা শায়খের স্নেহধন্য। শায়খের বরকতি স্নেহ তারা হেলায় হারাতে রাজি নন।

 

০৩

একটা ঐশী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে এতো অস্বচ্ছতা এবং অনিয়ন্ত্রিত নিয়োগ প্রক্রিয়া থাকাটা মোটেও সুখকর কিছু নয়। খুব সহজ ও সিম্পল পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করলেই এ ধরনের অনিয়মতান্ত্রিক নিয়োগ ও ছাটাই প্রক্রিয়াকে নিয়মতান্ত্রিক করা সম্ভব। এতে প্রতিষ্ঠানেরও যেমন লাভ হবে, শিক্ষকদেরও আখেরে ফায়দা হবে।

বিশেষত ট্রান্সফার সার্টিফিকেট এবং প্রত্যয়নপত্রের ব্যবস্থা করাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। কোনো শিক্ষক যদি এক মাদরাসা থেকে আরেক মাদরাসায় চলে যান, তবে তাকে নতুন মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরুর আগে অবশ্যই ট্রান্সফার সার্টিফিকেট এবং চারিত্রিক প্রত্যয়নপত্র প্রদর্শন করতে হবে। একই সঙ্গে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদও প্রদর্শন করতে হবে। এতে করে লাভ যেটা হবে- এ শিক্ষক পূর্বের মাদরাসায় কোনো অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কী-না, সে ব্যাপারে পূর্ণ ওয়াকিফহাল হওয়া যাবে।

মাদরাসার শিক্ষকগণও হুট করেই যাতে আরেক মাদরাসায় চলে না যান, এই মানসিকতা রুদ্ধ করতে প্রতিটি মাদরসায় পেনশন ও গ্র্যাচুইটির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষকদের প্রতিমাসের বেতন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পেনশনের জন্য জমা রাখা হবে। শিক্ষক যখন মাদরাসা থেকে চলে যাবেন বা তার চাকরি যখন শেষ হয়ে যাবে তখন তাকে এই টাকা প্রদান করা হবে। কওমি মাদরাসার একজন শিক্ষক ত্রিশ-চল্লিশ বছর চাকরি করার পর যখন অবসরে যান, তখন একেবারে শূন্যহাতেই মাদরাসা থেকে বিদায় নেন। অথচ সামান্য উদ্যোগ নিলেই তিনি বার্ধক্যের দিনগুলো স্বচ্ছলভাবে কাটাতে পারেন। এ উদ্যোগ মাদারাসাকেন্দ্রিক হতে পারে, আবার কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডকেন্দ্রিকও হতে পারে।

 

০৪

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া নামের কওমি মাদরাসার যে শিক্ষাবোর্ড আছে, সেটাও বড় এক আজব প্রতিষ্ঠান। বেফাকঘনিষ্ঠ আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘বেফাকে যারা কর্মরত আছেন, তাদের নিয়োগ কীভাবে হয়? নিয়োগের জন্য কোনো বিজ্ঞাপন হয় বা কোনো পরীক্ষা পদ্ধতি আছে নাকি?’

সে উদারভঙ্গিতে বললো- ‘না তো! মহাসচিব বা সভাপতি-সহসভাপতিরা যাকে যোগ্য মনে করেন তাকে নিয়োগ দেন। এ ব্যাপারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট স্বচ্ছতা থাকে!’

তার কথা ‍শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম! একটা শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে কোনো ধরনের সার্কুলার বা পরীক্ষার ব্যাপার নেই, এটা এই যুগেও এসে আমাদের শুনতে হয়! যে শিক্ষাবোর্ডের অধীনে হাজার দশেক মাদরাসা এবং লাখ পনেরো ছাত্র পরিচালিত হয়, সেখানে নিয়োগের ব্যাপারে কোনো বিধিবদ্ধ কোনো কনস্টিটিউশন নেই।

অথচ এই এক বেফাক যদি বিভিন্নজনের লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করে কেবল কওমি মাদরাসার শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দিতো, কওমি শিক্ষাব্যবস্থা এতোদিনে বিশ্বের অন্যতম আলোচিত এবং আলোকিত শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নীত হতে পারতো। বিশ্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা হওয়ার জন্য কওমি মাদরাসগুলোতে সকল সম্ভাবনা বিরাজমান। কিন্তু মাদরাসা কর্তৃপক্ষের গাফলতির কারণে আমরা এ শিক্ষাব্যবস্থাকে মানুষের করুণার শিক্ষাধারা করে রেখেছি। একটু পজেটিভ দৃষ্টিতে দেখলেই বুঝা যায়- অযুত সম্ভাবনাময় এ শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু সরকারও যেমন কওমিয়ানদের দূরে রাখতে পছন্দ করে, তেমনি ছুঁচোর ভয়ে কওমিয়ানরাও সরকার বা বৈশ্বিক অগ্রযাত্রার পথে নিজেদের শামিল করতে বরাবরই অনাগ্রহী।

আমাদের দুঃখ- কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে, কীভাবে উন্নত করা যাবে, কোথায় কোথায় পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে হবে, এসব বিষয়ে জ্ঞান দেয় আমেরিকান অ্যাম্বাসি আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। কওমিয়ানরা তাদের কথা শুনে তেড়ে উঠে বলে- দুর হ শয়তান! কিন্তু শয়তানকে আর কতোদিন দূরে রাখবেন? নিজের কাজটা নিজে না করলে একদিন দেখবেন তারা এসে ঘাড় ধরে তাদের দাবি আদায় করে ছাড়বে।

যাক, শুনছি বেফাকের নতুন মহাসচিব নাকি বেফাককে ঢেলে সাজাবার তোড়জোড় শুরু করেছেন। সেটা কতোদূর সম্ভব হবে, সময়ই বলে দেবে। তবে তার পথ যে মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ হবে না, এ ব্যাপারেও মহাসচিবকে পূর্ণ ধারণা রাখতে হবে। কেননা, বীজ থেকে এতোদিনে গজিয়ে গেছে অসংখ্য আগাছা চারাগাছ! এসব আগাছা পরিস্কার করে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বজয়ের পথে আগুয়ান হোক, এমন প্রত্যাশা সবসময়ের।