লেখালেখি বিষয়ে কিছু কথা বলতে হয়। তবে যে কথাগুলো এখন বলবো সেগুলো শুনতে খুব একটা আরাম লাগবে না অনেকেরই। কিন্তু বিষয়গুলো বলতেই হবে, আমাদের বৃহৎ স্বার্থেই।

ব্যক্তিগতভাবে আমি ‘নবপ্রকাশ’ নামের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। বছর দু-তিন হল নবপ্রকাশের যাত্রা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু আলোচিত গ্রন্থ প্রকাশ করে সুনাম অর্জন করেছে প্রকাশনীটি। প্রকাশনাশিল্পের সঙ্গে এ যাত্রপথে নানা ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। সে অভিজ্ঞতার দু-চারটে সবার সঙ্গে শেয়ার করা উচিত মনে করছি।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ব্যবসায়িকভাবে নবপ্রকাশ থেকে আমরা এমন বই বের করতে আগ্রহী, যেসব বই অন্য আর দশটা ইসলামি প্রকাশনী প্রকাশ করে না বা করতে আগ্রহী নয়। প্রকাশনা শুরু করার আগে আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল—আমরা এমন একটি প্রকাশনী করতে চাই, যে প্রকাশনী পাশ্চাত্য প্রদর্শিত পাঠোপকরণ থেকে বর্তমান তরুণদের আপন আলয়ে ফিরিয়ে আনবে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণ ইংরেজি ও পাশ্চাত্য বিভিন্ন ভাষার বই অনূদিত হচ্ছে। সেসব বইয়ের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সমাজ, সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি হুড়মুড় করে আমাদের সমাজে ঢুকে পড়ছে। আমাদের তরুণরা বিশ^সাহিত্য অধ্যয়নের মোহে আটকা পড়ে যাচ্ছে পশ্চিমা বেহায়া সংস্কৃতির নাগপাশে। আমাদের লক্ষ্য—আমরা এমন বই প্রকাশ করতে সচেষ্ট হবো যেসব বই এই পশ্চিমা অপসংস্কৃতিকে কিছুটা হলেও রুখে দাঁড়াবে।

আমাদের যুক্তিটি ছিল পরিস্কার—ইতিহাসের বদলে ইতিহাস, উপন্যাসের বদলে উপন্যাস, গল্পের মুখোমুখি গল্প। যে যুবক ড্যান ব্রাউনের ‘অরিজিন’ পড়ার জন্য মুখিয়ে আছে তাকে তো আপনি ‘মকছুদুল মোমেনিন’ পড়িয়ে তৃপ্ত করতে পারবেন না। যে পাঠক উইলবার স্মিথের ‘রিভার গড’ পড়ে অভ্যস্ত, তাকে ‘তালেবানের মেয়ে’ পড়িয়ে ইসলামি পাঠাগ্রহে অভ্যস্ত করতে পারবেন না। 
বর্তমান সময়ের পাঠকের পাঠরুচি আপনাকে বুঝতে হবে।

এসব কারণে আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত অনেক প্রয়োজনীয় বই অনুবাদ করে প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়ে আমাদের। বই অনুবাদ করতে গিয়ে নানা বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেসব বেদনার কথা পাঠকমাত্রই জ্ঞাত হওয়া প্রয়োজন।

প্রথম কথা: যোগ্য অনুবাদকের প্রচুর অভাব। হোক সেটা আরবি-উর্দু কিংবা ইংরেজি, সব ভাষাতেই দক্ষ অনুবাদকের অভাব প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। বাজারে অনুবাদকের অভাব নেই, কিন্তু দক্ষতাসম্পন্ন, মননশীল, সম্যক ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন অনুবাদক হাতেগোনা। ইদানীং অনেক প্রকাশনী বিভিন্ন ভাষার বই অনুবাদ করে প্রকাশ করছেন।

ইসলামি প্রকাশনাজগতে প্রকাশনীর অভাব নেই। শত শত প্রকাশনী বাংলাবাজারসহ সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রতিমাসে এসব প্রকাশনী শত শত বই প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু মানসম্পন্ন বই কয়জন প্রকাশক প্রকাশ করছেন, এটা হাতে গুনে বলে দেয়া যায়। এছাড়া আরও কিছু সমস্যা রয়েছে, সে বিষয়গুলো পরে বলছি।

দ্বিতীয় কথা: লেখক-অনুবাদকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব। অনেকবার এমন হয়েছে, কোনো অনুবাদক নিজ থেকে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। জানিয়েছেন, তিনি আমাদের প্রকাশনীর কোনো বই অনুবাদ করতে চান। তাঁর আগ্রহ এবং আমাদের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে তাঁকে আমরা অনুবাদের জন্য একটি আরবি বা ইংরেজি বই দিলাম। বই দেয়ার সঙ্গে আমরা বইয়ের কলেবর অনুযায়ী একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দেই। সেটা তিন থেকে পাঁচ মাস হয়ে থাকে, বইয়ের আকার অনুপাতে। যদিও এ সময়ের মধ্যে তিনটি বই অনুবাদ করে ফেলা যায়, তবু অনুবাদকের সুবিধা এবং অনুবাদ যথাযথ হওয়ার তাগিদে আমরা তাঁকে সময়ের বাগডোরটা একটু বাড়িয়েই দেই। কিন্তু অনেকবার এমন হয়েছে, এ নির্ধারিত তিন-পাঁচ মাস সময়ে অনুবাদক বইয়ের এক পৃষ্ঠাও অনুবাদ করেননি। অথচ এক সপ্তাহ দু সপ্তাহ পর পর তাঁকে ফোন করে কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। তিনি আশ^স্ত করেছেন, কাজ হয়ে যাবে। আখেরে দেখা গেছে তিনি বইয়ের কিছুই অনুবাদ করেননি।

এই যে পেশাদারী (প্রফেশনাল) মনোভাবের অভাব, এমন অপেশাদারিত্ব নিয়ে কীভাবে একজন লেখক বা অনুবাদক নিজেকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন? আরেকটি কথা এখানে বলে নেয়া ভালো, পেশাদারী মনোভাবের অভাবে লেখক-অনুবাদকরা লেখালেখিকে কখনোই সিরিয়াসলি নেন না। তাঁরা মনে করেন, লেখালেখিটা একটা শখের বিষয়। সময়-সুযোগ হলে লিখবো, ইচ্ছা না হলে লিখবো না। কিন্তু তাঁর স্মরণ রাখা প্রয়োজন, তাঁর কাছে লেখালেখি খাম-খেয়ালির বিষয় হলেও প্রকাশকের কাছে বই অনুবাদ করে বা পা-ুলিপি তৈরি করে বই প্রকাশ করা রুটিরুজির প্রশ্ন। একজন লেখক যদি সঠিক সময়ে তাঁর কাজটি শেষ না করে দেন তবে প্রকাশক অবশ্যই ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

পেশাদারী মনোভাবের অভাবের বিষয়টি শুধু প্রকাশককে বিপদে ফেলছে তাই কিন্তু নয়, এর দ্বারা ওই লেখক বা অনুবাদকও গোনাহগার হচ্ছেন। লেখক প্রকাশককে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারছেন না, এটা তো অবশ্যই গোনাহর মধ্যে পড়ে। প্রকাশক তাঁকে নির্দিষ্ট সময় দিয়ে বই লেখা বা অনুবাদের সময় দিয়েছেন, কিন্তু লেখক সেটা নির্দিষ্ট সময়ে দিলেন না, এর দ্বারা প্রকাশকের যে লোকসান হলো, এর দায়ভার কে নেবে? ওই লেখক যদি নিজের অপারগতা আগেই প্রকাশ করে কাজটি না নিতেন তাহলে প্রকাশক অন্য কাউকে দিয়ে কাজটি করাতেন। তাতে তাঁর লোকসানের সম্মুখীন হতে হতো না।

আবার সম্মানীর অর্থ পাওয়ার পরও নির্দিষ্ট সময়ে পাণ্ডুলিপি দিতে পারেননি কিংবা পাণ্ডুলিপি আরেক প্রকাশকের কাছে বিক্রি করেছেন কিংবা অর্থের কথা অস্বীকার করেছেন, এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ বাংলাবাজারের প্রকাশকদের কাছে বসলেই শোনা যায়। অথচ যারা লেখক হিসেবে নিজেদের দাবি করছেন তাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজের মান্যজন, বড় মাওলানা, মাদরাসার মুহাদ্দিস কিংবা মসজিদের ইমাম সাহেব।

এমন আরও অনেক অপেশাদারী মানসিকতা আমাদের লেখকদের মধ্যে ছড়িয়ে আছে, যার পরিশোধন হওয়া প্রয়োজন।

আপনি লিখতে পারেন—লেখক হয়েছেন, ভালোকথা। আপনি এখন একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর আইডল হিসেবে বিবেচিত। আপনাকে দেখে অসংখ্য পাঠক অনুপ্রাণিত হবে, আপনার জীবনাচার তাঁকে আকৃষ্ট করবে। কিন্তু আপনার মধ্যে যদি সাধারণ মনুষ্যত্ববোধ, দায়িত্বজ্ঞান, পাপবোধ, পেশাদারি মনোভাব না থাকে তবে আপনার লেখক হওয়ার তো আমি তেমন ফায়দা দেখি না। একজন লেখক মানে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। আপনার মধ্যে যদি অনুসরণের এমন বদগুণ প্রস্ফুটিত হয় তবে সাধারণ পাঠক কীভাবে আপনাকে অনুসরণ করবে?