১৯৩৯ সাল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ১৯ বছরের টগবগে তরুণ। গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। মাথুরানাথ স্কুল পরিদর্শনে এসেছেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

স্কুল পরিদর্শন শেষে তাঁরা যখন স্থানীয় ডাকবাংলোর দিকে যাচ্ছিলেন তখন হঠাৎই রাস্তার সামনে পথরোধ করে দাঁড়াল কয়েকজন স্কুলছাত্র। কী ব্যাপার! সবাই চমকে যায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক তেড়ে আসেন- ‘এ্যাই, কী চাও তোমরা? রাস্তার সামনে এসে দাঁড়ালে কেন?’

রোগা হ্যাংলা মতো একটা ছেলে সামনে এসে স্পর্ধিত কণ্ঠে বলল, ‘আমরা এই স্কুলেরই ছাত্র। স্কুলের ছাদে ফাটল ধরেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সেখান থেকে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে আমাদের বই-খাতা ভিজে যায়। ক্লাস করতে অসুবিধা হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার এ ব্যাপারে বলা হলেও কোনো ফল হয়নি। ছাদ সংস্কারের আর্থিক সাহায্য না দিলে রাস্তা মুক্ত করা হবে না।’

এই লম্বা লিকলিকে তরুণটি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক তরুণের এমন সাহসী প্রতিবাদ দেখে শেরে বাংলা তখনই স্কুলের ছাদ সংস্কারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এই শেরে বাংলা এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধুর দীক্ষাগুরু। 

আজকে বাংলাদেশের কিশোর-তরুণরা যে প্রতিবাদ করছে, সবাই বঙ্গবন্ধুর ওই বয়সেরই। স্কুলশিক্ষার্থী হত্যার বিচারের দাবিতে পাঠকক্ষ ছেড়ে নেমে এসেছে রাস্তায়। এরা তো বঙ্গবন্ধুরই প্রতিচ্ছায়া।

সামান্য ছাদ সংস্কারের দাবিতে বঙ্গবন্ধু কয়েকজন ছাত্র নিয়ে সেদিন রাশভারী শেরে বাংলার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন; আজ বঙ্গবন্ধুর প্রণীত বাংলাদেশে লাখ লাখ ছাত্র তিনজন বন্ধুকে হত্যার ন্যায়বিচারের দাবিতে ঢাকার রাস্তায় নেমে এসেছে। এ ছাত্রদের আপনি দোষ দেবেন কোন যুক্তিতে? এরা কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাইরে কিছু করেছে? 

বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সামনে, আজকের আন্দোলনরত ছাত্ররা দাঁড়িয়েছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সামনে। তিনি আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের সবচে বেশি সময়কালের প্রধানমন্ত্রী। তিনি দরদি এবং সাহসী। তিনি কি এই প্রতিবাদরত ছাত্রদের মুখে তাঁর পিতার তরুণ বয়সের মুখচ্ছবি দেখতে পান না? তাদের দাবি কি অন্যায্য কিছু? বন্ধুহত্যার বিচার দাবি কি লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দমন করার মতো অপরাধ? স্কুলের ছাত্রদের রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কিছু?

হয়তো মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ভুলে গেছে, হয়তো রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে মিথ্যা চটকদার বক্তৃতা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মাটি কি বঙ্গবন্ধুকে ভুলে গেছে? এই মাটির স্বাধীনতা যিনি এনেছিলেন, মাটি কখনো তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। আর এই ছাত্ররা এ মাটিরই সন্তান। তারা প্রত্যেকেই একেকজন বঙ্গবন্ধু। তারা স্বার্থের লোভে বঙ্গবন্ধুকে বিক্রি করার তালিম এখনও শিখেনি, তারা তাই একেকজন সলিড শেখ মুজিব। 

সামনেই ১৫ আগস্ট। ঘাতকের বুলেট এ দিন বঙ্গবন্ধুকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি মাটি হয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি নগর-গ্রামে ছড়িয়ে গেছেন। ন্যায় আর অধিকার আদায়ের প্রতিটি স্লোগানে তিনি বিস্ফোরিত হন। ন্যায়বিচার প্রত্যাশী প্রতিজন তরুণের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় তারই বজ্রহুংকার- ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’!