লোকটা নামাজ পড়ছিলো। ‘নামাজ পড়ছিলো’-এ কথা না বলে বলা উচিত-লোকটা ঈশ্বরের প্রণতি করছিলো। তার প্রণতিকে প্রথাবদ্ধ নামাজ বলা যাবে না। অদেখা কোনো ঈশ্বরের আরাধনায় কখনো লুটিয়ে পড়ছিলো মরুর বুকে, কখনো দাঁড়িয়ে আরতি করছিলো বিড় বিড় করে, আবার কখনো হাত তুলে প্রার্থনায় মশগুল হচ্ছিলো। লোহিত সাগর থেকে উঠে আসা উড়নচণ্ডী বাতাসে থেকে থেকে দুলে উঠছিলো তার পাগড়ির আস্তিন।

দূর থেকে তাকে এমন প্রার্থনা করতে দেখে এগিয়ে এলো তার গোত্রের এক লোক। গোত্রের লোকজন সকলেই বহুশ্বরবাদী, লাত-মানাত-হোবল দেব-দেবীর প্রণতি করে তারা। তবে এ-ই একমাত্র ব্যক্তি—মূর্তিপূজায় যার আস্থা নেই। বলে, সে নাকি একক ঈশ্বর ‘আল্লাহর’ প্রণতি করে। পাথরের নির্জীব আর নির্বীয মূর্তির প্রতি তার কোনো প্রকার সম্ভ্রম নেই।

লোকটি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘আবু জর, কী করছো?’
আবু জর কাপড় থেকে ধুলো ঝেরে বললেন, ‘প্রার্থনা করলাম।’
‘আচ্ছা, কাকে উদ্দেশ্য করে প্রার্থনা করলে, বলো তো!’
‘কাকে আবার? আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করলাম।’
‘কিন্তু তুমি তো কাবার দিকে সেজদা দিলে না, আবার জেরুসালেমের দিকে ফিরেও সেজদা দিলে না। ওগুলোই তো আল্লাহর ঘর।’
আবু জরের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি, ‘ওসব ঘর তো এখন হোবল আর মানাত-উজ্জার প্রতিমায় পঙ্কিল। আমি একক আল্লাহকে সেজদা করি। তার কোনো ঘরের প্রয়োজন হয় না। তাঁকে যে কোনো দিকে সেজদা করা যায়।’
‘বেশ বেশ…।’ লোকটি একটু থেমে আবার বলে, ‘খবর শুনেছো নাকি?’
‘কী খবর?’
‘মক্কায় একজন নবির আগমন হয়েছে। তিনিও নাকি তোমার মতো এক আল্লাহর ইবাদত করেন। মানুষকে দেব-দেবী আর মূর্তিপূজা ছেড়ে আল্লাহর প্রভুত্বের দিকে আহ্বান করেন। মক্কায় তো তাকে নিয়ে রৈ রৈ অবস্থা। শুনেছো তার খবর?’

আবু জরের চোখ আগ্রহে চক চক করে ওঠে। সত্যি আরবে একজন নবি এসেছেন? যিনি মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন, দেব-দেবীর পূজা ঘৃণা করেন, মানুষকে ঐশী বিশ্বাসের কথা বলেন? এমন মানুষ তবে সত্যি আগমন করেছেন মক্কায়?

আবু জরের গোত্র গিফার, মূল গোত্র কিনানার শাখা। অবশ্য কিনানা গোত্র মক্কার কুরাইশ গোত্রেরও আদি শাখা। কিনানার আরও বহু শাখাগোত্র হেজাজের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। কেউ এখনও যাযাবর বেদুঈন রয়ে গেছে, আবার কেউবা মক্কা বা তায়েফের ভদ্রসমাজে গিয়ে থিতু হয়েছে নাগরিক জীবনে।

গিফার গোত্রের বসবাস মক্কা থেকে উত্তর-পশ্চিমে, মদিনা থেকে কাছেই, লোহিত সাগরের পাড়ে ওয়াদ্দান উপত্যকার পাশে। গোত্রের লোকদের প্রধান জীবিকা পশুপালন আর বাণিজ্যকাফেলার নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ।

ওয়াদ্দান উপত্যকার পাশ দিয়ে চলে গেছে পারস্য ও সিরিয়াগামী বাণিজ্য সড়ক। এ সড়ক দিয়ে গরমের মৌসুমে আরবের বিভিন্ন গোত্রের বাণিজ্যকাফেলা চলে যায় সিরিয়ার বিভিন্ন বাজার-আড়তে, আবার শীত মৌসুম আসতে আসতে তারা ফিরতি পথ ধরে আরবের। সঙ্গে থাকে কিশমিশ, তেল, সুগন্ধি, কাপড়, সোনা-রুপাসহ নানা প্রকার মূল্যবান তৈজসপত্র।

তবে পথে দস্যু ও ডাকাতদলের ভয় আছে। বিভিন্ন বেদুঈন গোত্র আছে যারা দস্যুবৃত্তি করেই জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের হাত থেকে বাঁচতে তাই বাণিজ্যকাফেলার জন্য প্রয়োজন হয় পেশাদার নিরাপত্তারক্ষীর। গিফার গোত্রের যোদ্ধারা নির্দিষ্ট মজুরির বিনিময়ে নিরাপত্তা প্রদান করে এসব বাণিজ্যকাফেলার।

কিন্তু গোত্রের সবাই যে ভদ্রমাফিক নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করে, এমন নয়। গিফারের দলছুট অনেকেই আছে যারা গোত্রীয় পেশার বাইরে এসে ছোটখাটো দস্যুদল তৈরি করে স্বাধীনভাবে দস্যুবৃত্তি করে বেড়ায়।

আবু জর গিফারি এমনই এক দলছুট দস্যু। আসল নাম জুনদুব ইবনে জুনাদাহ!