ড. আফিয়া সিদ্দিকিকে না চেনার কথা নয়। বাংলাদেশ তো বটেই, পুরো মুসলিমবিশ্বেই তিনি বেশ পরিচিত একটি নাম। ১৯৭২ সালে জন্ম নেয়া এই পিএইচডি ডিগ্রিধারী মুসলিম নারী বর্তমানে কারাবাস করছেন আমেরিকার একটি কারাগারে। ২০০৩ সালে তিনি পাকিস্তানের করাচি থেকে নিরুদ্দেশ হন এবং ২০০৮ সালে তিনি আফগানিস্তানের গজনিতে আফগান পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। মাঝের এই পাঁচ বছর তিনি কোথায় ছিলেন? তার সমর্থকরা বলেন, পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স তাকে অপহরণ করে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়। কিন্তু পশ্চিমারা বলছে, এই পাঁচ বছর তিনি ওসামা বিন লাদেনের একজন সহযোগী হয়ে আফগানিস্তানে কাজ করেন।
২০০৮ সালের ১৭ জুলাই গ্রেফতার হওয়া ড. আফিয়াকে আমেরিকার একটি আদালত ২০১০ সালে ৮৬ বছরের কারাদ-ে দ-িত করেন।
২০১৩ সালে আমেরিকার বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘নিউজউইক’-এ সাংবাদিক জেনিন ডি জিওভান্নি তাকে নিয়ে অনুসন্ধানধর্মী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। সেই প্রতিবেদনের ভাষান্তর তুলে ধরছি।

এখনকার যেটা ‘ইসলামিক স্টেট’, এই গ্রুপটিরই আগের নাম এবং পরিচিতি ছিলো ওঝওঝ বলে। আমেরিকান সাংবাদিক জেমস ফয়লেকে হত্যা করার পর আইসিসযোদ্ধারা তার পরিবারের কাছে একটি ইমেইল বার্তা পাঠায়। যেখানে লেখা ছিলো- ‘অনেক মুসলিম এখনো তোমাদের বন্দিশালায়।’

ইমেইল বার্তাটিতে একজন নারীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। তিনি ড. আফিয়া সিদ্দিকি। ফয়লের শিরশ্ছেদের দুই সপ্তাহ পর আইসিস স্টিভেন সটলোফ নামের আরেকজন আমেরিকান সাংবাদিককে অপহরণ করে। তবে তারা কোনো বন্দিবিনিময়ের প্রস্তাব দেয়নি বলে অনেকে ধারণা করেন। দুঃখজনক সত্য হলো, সটলোফেরও শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়।

এ সময় আফিয়া সিদ্দিকির নামটি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ সাইটে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় এবং তিনি বিনিময়ের বস্তু হিসেবে বিবেচিত হন। শুধু আইসিস নয়, তালেবানসহ অন্য আরও কয়েকটি জিহাদি গ্রুপ তার মুক্তির জন্য বন্দিবিনিময়ের প্রস্তাব দেয়। সুতরাং, বিষয়টি আমাদের জানা দরকার, কে এই আফিয়া সিদ্দিকি এবং কীভাবে তিনি আমেরিকার ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আয়োজনের ঘেরাটোপে পড়ে গেলেন।

সাংবাদিক জিওভান্নি আফিয়া সিদ্দিকির বিচার নিয়ে লেখেন:
আফিয়া সিদ্দিকি কিংবা ‘লেডি আল-কায়েদা’, এ নামেই তিনি ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আয়োজকদের কাছে পরিচিত। ২০১০ সালে আমেরিকার ম্যানহাটন ফেডারেল কোর্ট তাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় দোষী সাব্যস্ত করেন এবং ৮৬ বছরের কারাদ-ে দ-িত করেন। ২০০৮ সালে তাকে আফগানিস্তানে আমেরিকান সৈন্যদের হত্যাপ্রচেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় বলে আদালতে জানানো হয়।
এমআইটি ও ব্র্যান্ডিস ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত ৪২ বছর বয়সী এ নিউরোসায়েন্টিস্ট বর্তমানে তার ৮৬ বছর কারাদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার অপেক্ষায় আছেন। টেক্সাসের কার্সওয়েল কারাগারে বন্দি এ সায়েন্টিস্টকে বিশেষ মেডিকেল সাপোর্টের মাধ্যমে আটকে রাখা হয়েছে।

ড. আফিয়া সিদ্দিকির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি আল-কায়েদার একজন সমর্থক এবং ওসামা বিন লাদেনের হয়ে কাজ করতেন। আহমদ, মারিয়াম ও সুলায়মান নামের তিন সন্তানের জননী আফিয়া অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুটি অভিযোগের রায় ঘোষণা করা হয়েছে- অবৈধ অস্ত্র বহন এবং সশস্ত্র অবস্থায় আমেরিকান সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করা।

মার্কিন সরকারের প্রসিকিউটর নিজের দাবির সত্যতার দোহাই দিয়ে প্রমাণ পেশ করেন, ২০০৮ সালের জুলাই মাসে আফগানিস্তানের গজনিতে আফিয়া সিদ্দিকিকে ইন্টারোগেশনের সময় তিনি এক সামরিক অফিসারের এম-৪ রাইফেল ছিনিয়ে নেন এবং এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে বলেন, তিনি সে সময় বলছিলেন, ‘আমি তোদের সবাইকে খুন করবো হারামির বাচ্চা!’ এবং ‘আমেরিকার মরণ আসছে!’

অবশ্য ড. আফিয়ার পক্ষের আইনজীবী টিনা এম ফস্টার দাবি করেন, তারা তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ফরেনসিক প্রমাণাদি পেশ করতে পারেননি। তিনি নিজের দাবির পক্ষে জোর দিয়ে বলেন, রাইফেলের গায়ে কোনো ধরনের ফিঙ্গারপ্রিন্টও পাওয়া যায়নি।
সরকারি প্রসিকিউটর তার স্টেটমেন্টে দাবি করেন, সৌভাগ্যক্রমে তার গুলিবর্ষণে কেউ আহত হননি। তবে তাকে নিবৃত করতে একজন অফিসার তার তলপেটে প্রচ- রকম আঘাত করেন। এতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে হেলিকপ্টারযোগে তাকে কাবুলের নিকটবর্তী বারগাম ইউএস এয়ারফিল্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে অবস্থার উন্নতি না হলে ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট আফগান সরকারের অনুমোদনক্রমে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর এক মাসের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়।

জিওভান্নি আরও লেখেন:
২০১০ সালে প্রথম তাকে ম্যানহাটন আদালতে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। সেখানে তাকে দৃঢ় এবং যথেষ্ট মানবিক বলে বলীয়ান মনে হচ্ছিলো। তিনি এতোটাই স্পষ্টবাদী ছিলেন তখন, আদালতকক্ষে সবার সামনে কামনা করেন- বিচারকদের মধ্যে কোনো ইহুদি যেনো না থাকেন। তিনি বলেন, ‘যদি ইসরাইলি বংশোদ্ভূত কোনো ইহুদি এখানে থাকে, তবে তারা অবশ্যই আমার প্রতি অবিচার করবে।’ তিনি বিচারক রিচার্ড বারম্যানকে বলেন, ‘আপনি যদি ন্যায্য বিচার কামনা করেন, তবে তাদের এখান থেকে বের হয়ে যেতে বলুন। এই রায় সরাসরি ইসরায়েল থেকে আসছে, আমেরিকা থেকে নয়। আমাকে সুযোগ দেয়া হলে আমি তা প্রমাণ করে দেখাতে পারবো।’ অবশ্য তার এমন স্পষ্টবাদী বক্তব্যের কারণে রিচার্ড বারম্যান তাকে আদালতকক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেন।

আদালত চলাকালীন একজন আর্মি ক্যাপ্টেন যখন তাকে দোষী বলে শনাক্ত করেন, তখন তিনি চিৎকার করে বলেন, ‘এটা পুরোপুরি হাস্যকর। আপনি মিথ্যা বলছেন।’

তার আইনজীবীরা প্রমাণের অপ্রতুলতার বিষয়টি তুলে ধরে মামলাটির দুর্বলতা ব্যাখ্যা করেন, কিন্তু বিচারক সেসব বিষয়ে তোয়াক্কা না করে তড়িঘড়ি করেই রায় দিয়ে দেন। ড. আফিয়ার আইনি লড়াইয়ে নিযুক্ত আইনজীবীদের একজন ইলেন শার্প বলেন, ‘আমার মতে, এই রায় সম্পূর্ণ অন্যায় রায়। এখানে না আছে কোনো ফরেনসিক প্রমাণ আর সাক্ষীরাও সত্যপ্রকাশে একনিষ্ঠ নয়। তারা সাক্ষ্য দেয় ভয়ে, সত্যপ্রকাশের জন্য নয়।’

বিশ্বব্যাপী ড. আফিয়ার পক্ষে জনমতের কথা বলতে গিয়ে জিওভান্নি লেখেন:
লর্ড আহমাদ, লর্ড শাইখ, লর্ড প্যাটেল এবং এমপি মোহাম্মদ সরওয়ার নামের চারজন বৃটিশ পার্লামেন্টারিয়ান এই বিচারকে ‘ন্যায়বিচারের গর্ভপাত’ বলে আখ্যায়িত করে সিদ্দিকির মুক্তি দাবি করেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে পাঠানো এক চিঠিতে তারা উল্লেখ করেন, যে রাইফেল দিয়ে আফিয়া সিদ্দিকি গুলি করেছিলেন, সত্য হলে সেই রাইফেলের সায়েন্টিফিক ও ফরেনসিক প্রমাণ পেশ করার। পাকিস্তানের বিখ্যাত ক্রিকেটার এবং বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ইমরান খানও তার মুক্তির জন্য র‌্যালি করেছেন। আমেরিকার একজন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল সিদ্দিকির মামলাটির ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘আমেরিকার অন্ধকার সাম্রাজ্যের আরেকটি বলি হলেন তিনি।’

‘ইরান টিভি’র বরাত দিয়ে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ড. আফিয়া সিদ্দিকির বিষয়ে বন্দিবিনিময় করতে রাজি হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অফিশিয়াল এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি। ড. সিদ্দিকির বোন ড. ফওজিয়া, যিনি হার্ভার্ড বিশ^বিদ্যালয় থেকে নিউরোলোজি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষালাভ করেছেন, তিনি তার বোনের মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি জানান, তার ব্যাপারে তারা এখনো আশাবাদী। মামলা পরিচালনাকারী একজন আইনজীবীও এমনই আশা করেন। সিদ্দিকি মুক্ত হয়ে যদি কখনো পাকিস্তানে চলেও যান, তবু তার রহস্যকাহিনি হয়তো কখনোই সত্যের মুখোমুখি হবে না।

সাংবাদিক জিওভান্নি আফিয়া সিদ্দিকির পরিচয় দিতে গিয়ে লেখেন:
ড. আফিয়া সিদ্দিকির বেড়ে ওঠা করাচির এক উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে। আরব সাগর ও পারস্য সাগরের তীরবর্তী এবং আফগান সীমান্তের কাছাকাছি এ শহরটি সবসময়ই ‘সন্ত্রাসবাদের’ কারণে পরিচিত। বোগেনভিলিয়া ফুলের ঝাড়ঘেরা এক ভিলায় তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। বাবা ডাক্তার গুলশান ইকবাল ফিজিশিয়ান আর মা সাধারণ গৃহিণী। এখানেই ড. আফিয়া সিদ্দিকির বোন ফওজিয়ার সঙ্গে কথা হয় নিউজউইকের প্রতিবেদকের সঙ্গে। এ বাড়িতেই তিনি এখন বসবাস করেন আফিয়া সিদ্দিকির বড় ছেলে আহমাদ ও কন্যা মারিয়ামকে নিয়ে। আফিয়ার ছোট ছেলে সুলায়মান, ধারণা করা হয় সে শহিদ হয়ে গেছে। ২০০৩ সালে ড. আফিয়া যখন পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স দ্বারা অপহৃত হন, তখন সে হারিয়ে যায়। তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

দেয়ালে টাঙানো আছে এমআইটি থেকে ড. আফিয়া সিদ্দিকির হাস্যোজ্জ্বল গ্র্যাজুয়েশনের ছবি। একটি প্ল্যাকার্ডও টাঙানো আছে সেখানে। তাতে লেখা- ‘লিঙ্কনের স্বপ্ন : সবার জন্য ন্যায়বিচার’। নিচে লেখা- ‘তাহলে আফিয়া কেন পাবে না?’
ফওজিয়া তার বোনের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘সে জীবনে কখনো একটা পিঁপড়াকেও আঘাত করতো না। সে এতোটাই সংবেদনশীল ছিলো, কোনো প্রাণীর কষ্টও সহ্য করতে পারতো না। এসব দেখলে তার মুখ মলিন হয়ে যেতো। যদি তার পাশে কোথাও একটা বেলুনও ফুটতো, তবে সে চিৎকার করে উঠতো। এ কারণে আমার মা তাকে বেলুনের জায়গায় ফুটবল খেলতে দিতো।’

১৯৯০ সালে আফিয়ার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ভাই মুহাম্মদ যখন আমেরিকার টেক্সাসে চলে যান, আফিয়াও হোস্টন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করার জন্য তার সঙ্গে যান। সেখান থেকে তিনি এমআইটিতে ভর্তি হন এবং পিএইচডির আগ পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। এরপর ব্র্যান্ডিস ইউনিভার্সিটিতে তিনি কগন্যাটিভ নিউরোসায়েন্সের ওপর পিএইচডি করেন। সেখানকার তার সহপাঠী এবং শিক্ষকরা তাকে একজন অধ্যয়নপ্রিয় ও মৃদুভাষী বলেই স্বীকার করেন।

আফিয়ার শিক্ষক ড. পল ডি জিও তার গ্রেফতারের পর বোস্টন ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি এটা ভাবতেই পারি না যে এমন কিছু ঘটতে পারে। তাকে একজন গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তি মনে হয়েছে সবসময়। এর ব্যত্যয় আমি দেখিনি কখনো।’
পিএইচডি সম্পন্ন করার পর ড. আফিয়া করাচিরই আরেক ডাক্তার মুহাম্মদ আমজাদ খানকে বিয়ে করেন, তিনিও বোস্টনে পড়াশোনা করেছেন। ডা. আমজাদের কর্মস্থল বোস্টন হাসপাতালের কাছে বিশতলার অ্যাপার্টমেন্টে এই দম্পতি তাদের দুই বাচ্চা নিয়ে বসবাস করতেন। তার প্রতিবেশীরা তার ব্যাপারে কখনোই খারাপ কিছু দেখেনি। তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম গৃহিণী এবং একজন যত্নশীল মা। তাদের অ্যাপার্টমেন্টের পাশে অবস্থিত মসজিদের ইমাম আবদুল্লাহ ফারুক বলেন, ‘সে ছিলো একজন পারফেক্ট আমেরিকান মেয়ে এবং বোনের মতো স্নেহশীল।’

আফিয়া সিদ্দিকি বসনিয়া যুদ্ধের সময় এবং পরে যুদ্ধাহতদের সাহায্য করার জন্য মুসলিম কমিউনিটিতে তহবিল সংগ্রহ করতেন। তার বোন বলেন, ‘পৃথিবীর সব দরিদ্র লোকদের জন্যই তার ছিলো সীমাহীন দরদ। সে বৃদ্ধ মহিলাদের বাসস্থান, পাবলিক পার্ক এবং বসনিয়ার উদ্বাস্তুদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতো।’

যেভাবে ঘটনা হয়ে উঠলেন ড. আফিয়া সিদ্দিকি:
কিন্তু এখানে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিয়ে যায়। ২০০১ সাল থেকে এফবিআই তাকে এবং তার স্বামীকে গোপনে গভীর পর্যবেক্ষণ করতে থাকে তাদের তহবিল সংগ্রহে সন্দেহজনক কিছু পাওয়ার আশায়। তারা তার ইন্টারনেট হিস্ট্রি চেক করে ১০,০০০ ডলারের ক্রয়-সম্বলিত কিছু তথ্য পায়। যেগুলো ব্যয় করা হয়েছিলো আর্মার জ্যাকেট, নাইট গগলস এবং মিলিটারি বই ক্রয় বাবদ। ফস্টারের মতে, আমজাদ খান এগুলো ক্রয় করেছিলেন পাকিস্তানে শিকার করার জন্য।

৯/১১-এর পর আমেরিকায় পাকিস্তানিদের বসবাস কঠিন হয়ে পড়লে এই দম্পতি করাচি চলে আসেন। এখানে তাদের তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু এর কয়েক সপ্তাহ পর দুঃখজনকভাবে আফিয়া ও আমজাদ খানের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তী সময়ে ডা. খান দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আফিয়া দিন দিন র‌্যাডিক্যাল ইসলামে প্রভাবিত হচ্ছিলো এবং জিহাদের প্রতিও উদ্বুদ্ধ হচ্ছিলো।’

নিউজউইক প্রতিবেদক করাচিতে ডা. আমজাদ খানের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি একজন শ্মশ্রুধারী ধার্মিক ব্যক্তি এবং এখনো ডাক্তারি পেশায় আছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, তিনি মোটেও চরমপন্থী নন। তার সাবেক স্ত্রী তাকে জোর করে আমেরিকা থেকে আফগানিস্তানে যাওয়ার ব্যাপারে জোর দিচ্ছিলেন, যেখানে ততোদিনে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিলো। তিনি সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয় এবং একপর্যায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি মনে করেন, তার স্ত্রীর সঙ্গে আল-কায়েদা বা এ ধরনের জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগ ছিলো।

আফিয়া সিদ্দিকির পরিবার এবং আইনি সহায়তা প্রদানকারী দল আমজাদ খানের এই অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে তাকে প্রতিহিংসাপরায়ণ স্বামী বলে উল্লেখ করে। তারা বলে, সে তার সন্তানদের চায়। সুতরাং, সে যা ইচ্ছা তা-ই বলতে পারে।

যেভাবে নিরুদ্দেশ হন ড. আফিয়া সিদ্দিকি:
করাচিতে ফিরে আসার পর আফিয়া সিদ্দিকি তার সন্তানদের নিয়ে নিজের বাড়িতে মা ও বোনের সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। ২০০৩ সালের বসন্তে পরিবারের সঙ্গে আফিয়ার শেষ সাক্ষাৎ হয়। তিনি তার সাত বছর বয়সী বড় ছেলে, পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে এবং ছয় মাস বয়সী কোলের শিশুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। বাড়িতে বলে যান, তিনি এক আত্মীয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে প্লেনে ইসলামাবাদ যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি ইসলামাবাদ না গিয়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমান, যার হদিস আজ পর্যন্ত রহস্যাবৃত রয়ে গেছে।
তার সমর্থকরা বলেন, তার অন্তর্ধানের বিষয়টি সম্পৃক্ত পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে। তারা আল-কায়েদা নেতা খালিদ শেখ মুহাম্মদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তাকে অপহরণ করে, যাকে ২০০৩ সালের ১ মার্চ গ্রেফতার করা হয়েছিলো।

খালিদ শেখ মুহাম্মদের জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি এখন পর্যন্ত গোপন রাখা হয়েছে। তবে দ্য গার্ডিয়ান পরবর্তী সময়ে এক রিপোর্টে দাবি করে, খালিদ শেখ সিআইএর ওয়াটারবোর্ডিং নামের নির্মম নির্যাতনের সময় আফিয়া সিদ্দিকির নাম বলেন। অবশ্য ফস্টার এটাকে অস্বীকার করেছেন।

ফওজিয়া তার বোনের অন্তর্ধানের বিষয়টি বলতে গিয়ে বেদনাহত হন। তিনি বলেন, ‘আফিয়া এয়ারপোর্টে যাবার জন্য বাড়ি থেকে তার তিন সন্তানকে নিয়ে বের হয়। কিন্তু পথিমধ্যে দুজন মোটরসাইকেল আরোহী তাকে থামিয়ে বলে, তোমার মা অসুস্থ, এখনই বাড়ি যেতে হবে। এই বলে তারা তাকে তুলে নেয়।’

এই শেষ! এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত তার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তার সমর্থকরা মনে করেন, আইএসআই আমেরিকাকে তুষ্ট করতে আফিয়াকে তাদের হাতে তুলে দেয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে আইএসআইয়ের অনেক গোপন কারাগার এবং সেফহাউস রয়েছে, যার কোনো একটায় তাকে এই পাঁচ বছর বন্দি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং নির্যাতন করা হয়। এরপর তুলে দেয়া হয় ওয়াশিংটনের হাতে। তখনই ড. আফিয়ার খবর মিডিয়ায় প্রচারিত হয়।

আফিয়ার পরিবার তখন আইনজীবী ফস্টারকে আফিয়ার মামলাটি গ্রহণ করতে অনুরোধ করে। ফস্টার সেই লোক, যিনি বাগরাম কারাগারে বন্দি আরও অনেক কয়েদির মামলা লড়ছেন এবং তিনি জানেন যে কীভাবে আইএসআই কাজ করে। কয়েকজন রিপোর্টার অভিযোগ করেন, আফিয়া সিদ্দিকির মূল আইনজীবীকে বাদ দেয়া হয়েছিলো, কারণ তিনি ইহুদি ছিলেন। কিন্তু ফস্টার বলেন, তিনি পাকিস্তান সরকারের পেইড আইনজীবী ছিলেন। ফস্টার আরও বলেন, তার মক্কেলকে ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কয়েকটি সেফহাউসে আবদ্ধ রাখা হয় এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের সময় তাকে ড্রাগ দিয়ে অচেতন করে রাখা হতো।

২০০৮ সালের ১৭ জুলাই আফিয়াকে গজনি থেকে গ্রেফতার করা হয়। এটাই দেখানো হয় যে, তিনি ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই আফগান পুলিশের হাতে ধরা পড়েন, যখন তিনি হাতে বহন করছিলেন বিপজ্জনক বোমা এবং নিউ ইয়র্ক ল্যান্ডমার্কের একটি তালিকা, যেখানে ‘সোডিয়াম সায়ানাইডে’র মতো বিধ্বংসী কেমিক্যালের নাম লেখা ছিলো।

এফবিআই এজেন্ট যখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসে, তখন তিনি একটি হলুদ রুমালে আবৃত ছিলেন। সেখানে উপস্থিত ক্যাপ্টেন রবার্ট স্নাইডার পরে বলেন, ‘তিনি একজন অফিসারের রাইফেল ছিনিয়ে নেন এবং এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করেন।’
তার আইনজীবী ফস্টার বলেন, তিনি একজন আমেরিকান অফিসারের রাইফেল নিয়ে গুলি শুরু করলেন, অথচ কেউ আহত বা নিহত হলো না, এটা খুবই আশ্চর্যজনক। তাকে কেনইবা গজনি থেকে বাগরাম নিয়ে আসা হলো এবং সেখান থেকে সোজা আমেরিকা! অবশ্যই রহস্যময়!

ইউএস গভর্নমেন্ট এবং প্রসিকিউটররা অবশ্য ভিন্ন এক কাহিনি শুনিয়েছেন। তারা বলেন, ড. আফিয়া ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ‘হারানো বছর’গুলোতে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের পক্ষে বিভিন্ন হামলার পরিকল্পনা করতেন। ২০০৪ সালে ইউএস অ্যাটর্নি জেনারেল জন অ্যাশক্রফট তার নাম আল-কায়েদার মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত করেন। তার ব্যাপারে লেখা হয়- ‘সশস্ত্র এবং বিপজ্জনক।’

ড. আফিয়ার রহস্যময় বিয়ে নিয়ে জিওভান্নি লেখেন:
ড. আফিয়া সিদ্দিকির দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে কথা রয়েই গেছে। তিনি কি খালিদ শেখ মুহাম্মদকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি বর্তমানে গুয়েনতানামো বে কারাগারে বন্দি আছেন? দ্য গার্ডিয়ানের ভাষ্য অনুযায়ী, তার ডিভোর্সের ৬ মাস পর তিনি খালিদ শেখ মুহাম্মদের ভাগনে আম্মান আল বালুচিকে বিয়ে করেন। দ্য গার্ডিয়ান আরও অভিযোগ করে, এই বিয়ে আইএসআই এবং ইউএস গোয়েন্দা সংস্থা অ্যারেঞ্জ করেছিলো। অবশ্য তার পরিবার ও সমর্থকরা তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা অস্বীকার করেন।

তার জনপ্রিয়তার বিষয়ে সাংবাদিক জিওভান্নি লেখেন:
তার বিচারের রায় হওয়ার পর তিনি একজন আইকনে পরিণত হয়ে গেছেন। বৃটিশ অ্যাক্টিভিস্ট ইভন রাইডলি, সাবেক এই সাংবাদিক আফগানযুদ্ধে তালেবানের হাতে বন্দি হন এবং পরবর্তী সময়ে ইসলামে দীক্ষিত হন, তিনি সিদ্দিকির কেসটি হ্যান্ডল করছেন। রাইডলি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, মানুষ আসলে আমেরিকার প্রতি চরমভাবে ক্ষুব্ধ। এখন তারা আমেরিকার বিরুদ্ধবাদী যে কাউকেই তাদের আইকন ভাববে এবং এটাই সত্য।

ম্যারিল্যান্ডভিত্তিক ‘থ্রো জাস্টিস ফাউন্ডেশন’-এর সদস্য মাওরি সালা খানকে প্রশ্ন করা হলো, তিনি যদি সত্যিকার অর্থেই নির্দোষ হয়ে থাকেন, তাহলে বিশে^র চরমপন্থী দলগুলো কেন তার মুক্তি দাবি করছে? তিনি বলেন, এটা খুবই সহজ একটা উত্তর। তিনি অন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে বিশ^বাসীর কাছে একজন সিম্বলে পরিণত হয়েছেন এবং মুসলিম হওয়ার কারণে মুসলিমদের কাছে তিনি অবশ্যই হিরো হিসেবে গণ্য হবেন। কেবল মুসলিমরাই নন, আমেরিকার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলও তার মুক্তি দাবি করেছেন। আর আইসিস তার মুক্তি দাবি করেছে, কারণ তারা জানে পাকিস্তানে তিনি কতোটা জনপ্রিয়।

ওবামা প্রশাসন এই মুক্তিপণের ব্যাপারটি নাকচ করে দিয়েছে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র কেইটলিন হাইডেন ব্যাপারটি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘আফিয়া সিদ্দিকি বিভিন্ন মামলায় ৮৬ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছেন। ইউনাইটেড স্টেটস গভর্নমেন্ট তার ব্যাপারে কোনো ধরনের বন্দিবিনিময়ে রাজি নয়।’

অবশ্য আফিয়ার বোন ফওজিয়া ক্ষুব্ধ মতামত ব্যক্ত করেন এ ব্যাপারে। তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত অযৌক্তিক এবং অদ্ভুত ব্যাপার। তারা বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলছে। তারা তখন কোথায় ছিলো, যখন আমার বোন নিরুদ্দেশ ছিলো? তারা আমার বোনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা যুক্ত করে বিষয়টিকে আরও ঘোলাটে করছে।’

নিউজউইক-এর সাংবাদিক জেনিন জিওভান্নি তার প্রতিবেদনের উপসংহার টেনে বলেন:
জেলখানায় কেমন কাটছে ড. আফিয়া সিদ্দিকির দিনকাল? এ ব্যাপারে তার আইনজীবী ফস্টার জানান, তিনি দিনের ২৩ ঘণ্টাই বন্দি অবস্থায় কাটান। তার পরিবারের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের কোনো সুযোগ তার নেই। অন্য বন্দিদের দ্বারাও তিনি অনেক সময় আক্রান্ত হন। শারীরিকভাবে তিনি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। একদম ছোট একটা ইঁদুরের মতো। তাকে রাখা হয়েছে কয়েকজন জঘন্য চরিত্রের মহিলার সঙ্গে।

২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বরের পর থেকে তার পরিবারের কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। শেষ যখন সাক্ষাৎ হয়, তখন তারা মামলার রায়ের ব্যাপারে আপিল করার কথা বলেন তাকে। তিনি তখন শুধু বলেছিলেন, ‘তোমরা কি ভাবো তাতে কোনো পরিবর্তন আসবে?’


[পাদটীকা : কুরআনের হাফেজা ড. আফিয়া সিদ্দিকির মৃত্যু নিয়ে কিছুদিন আগে একটি ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম দাবি করে, আফিয়া সিদ্দিকি মারা গেছেন। তবে কোনো নির্ভরযোগ্য সংবাদ সংস্থা এ তথ্যের সত্যতার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। তার মৃত্যু নিয়ে আমেরিকান কোনো সরকারি সংস্থাও কোনো দায় স্বীকার করেনি। একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন, তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন।]