ছোটবেলায় আমি ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ কাব্যনাট্যটি পড়েছিলাম। আমার ছোট মনে কষ্ট এমন হু হু করে উঠেছিলো, মূলত আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। কষ্ট পেয়েছিলাম সাজুর জন্য। একটা গ্রাম্য লড়াইয়ের পর সাজুর বর (দুজনের প্রেমের বিয়ে, ক’দিন আগেই হয়েছে) রূপাই পুলিশের মৃত্যুর পরোয়ানার থেকে বাঁচতে গ্রাম থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সেই যে যায়, রূপাই আর কখনো ফেরে না। যাওয়ার আগে শুধু বলে যায়:
সখী দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই
সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই।
মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে
তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণতলে।

সাজু দিন-রাত তার জন্য ঘরের ‍উঠোনে বসে প্রতীক্ষায় থাকে, রাতে বাঁশের বেড়ার ফাঁক গ’লে জোসনা খলবলিয়ে সাজুর শরীর স্পর্শ করলে গোঙানো বেদনায় সাজু অনেক কাঁদে। কিন্তু রূপাই কোনোদিন আর ফেরে না। নাকি ফেরে?

কোনো এক ভরা জোসনা রাতে কেউ নাকি একদিন দেখেছিলো, সাজুর ঘরের পেছনে বাঁশঝাড়ের আড়ালে একটা জটওয়ালা পাগল ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন তাকে তাড়িয়ে দেয়নি। তাকে ডাকেওনি কেউ। কিন্তু দিন-দুপুরে পাগলটাকে কেউ কখনো দেখেনি এ তল্লাটে। পাগলের কি কোনো ঘর হয়?

পাশাপাশি দুটো গ্রাম নিহারীকার মতো বিষণ্ন হয়ে থাকে:
আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে
নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।

কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে
মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নকশী কাঁথাটি ধরে
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশিটি বাজায় করুণ সুরে
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ওগাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে।

একদিন সেই কাঁথা বোনা শেষ হয়ে গেলো। যার বুকজুড়ে সাজু এঁকেছে রূপাইয়ের ভালোবাসার অন্তিম সিলমোহর, সূচের ডগা দিয়ে ফুঁড়েছে বেদনার কারুকাজ, সেই কাঁথাটা বুকে আগলে নিয়ে সাজু তার মাকে বললো, ‘মা, আমার মরণের পরে যেখানে কবর দেওয়া হবে, সেই কবরের ওপরে যেন এই নকশী কাঁথাখানা বিছিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি কোনোদিন রূপাই এসে আমার খোঁজ করে, তাকে বোলো, তোমার আশায় সাজু ওই কবরের নিচে আছে। ওই নকশী কাঁথাটির নিচে…।’

বহুদিন পরে গাঁয়ের কৃষকেরা গভীর রাতে বেদনার্ত এক বাঁশির সুর শুনতে পায়, আর ভোরে সবাই এসে দেখে, সাজুর কবরের পাশে এক ভিনদেশি লোক মরে পড়ে আছে। কেউ তাকে চিনতে পারে না। তার পেহচান জানা নাই কারো। কে সে? কেউ এই জটাধারী পাগল লাশটা? কে গো তুমি, মরে পড়ে আছো কবরের ঢিবি মাটির উপর? 

জসিমউদ্দীনের ওই বইটার যে সংস্করণটা আমি পড়েছিলাম, ওটা ছিলো সচিত্র। কোনো এক নির্দয় শিল্পী এতো ডাগর করে এঁকেছিলো সাজুর মুখ, রূপাইয়ের তাগড়া জওয়ানি; আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। বইটির আঁকা চিত্রগুলো আমাকে পীড়া দিতো খুব। বিশেষ করে বইয়ের একেবারে শেষের দিকে, কবি যেখানে উদারহস্তে ঢেলেছেন রূপাইয়ের নিরুদ্দেশযাত্রা, সাজুর প্রতীক্ষার দীর্ঘ রজনীর হতাশ্বাস; সেখানে না—একটা ছবি আঁকা ছিলো। একা সাজু, ঘরের দাওয়ায় বসে রাতের বেলা একা একা একটা কাঁথা সেলাই করছে। আর সে কাঁথায় সুঁইয়ের প্রতিটি তীক্ষ্ম ভালোবাসায় ফুটে উঠেছিলো লড়াইরত রূপাইয়ের মুখাল্পনা। শপথ বলছি, কাঁথার ফুঁড়ে সাজুর প্রতিটি সূচালো আঘাত যেন আমার বুকে বিঁধেছিলো। সাজুর জন্য আমার এতো কষ্ট লেগেছিলো! আমি প্রায়ই বড়আপাকে জিজ্ঞেস করতাম—রূপাই কি আর কোনোদিন ফেরে না?

বড়আপা এ বইটা পড়ে প্রায়ই কাঁদতো। আমি কি কাঁদিনি? কান্নার ভয়ে আমি আর এ বইটার কাছাকাছি যেতাম না। এ তো নস্যি, কষ্ট পাওয়ার ভয়ে আমি জসিমউদ্দীনের আর কোনো বই-ই পড়তে যাইনি কোনোদিন। ঘরে ছিলো নকশিকাঁথার সিক্যুয়েল আরেকটি কাব্যনাট্য—সুজন বাদিয়ার ঘাট, আমি ছুঁয়েও দেখিনি। জসিমউদ্দীনের ‘কবর’ কবিতা পড়ি না এই ভয়ে। কোথাও কারো আবৃত্তি শুনতেই আমি আস্তে সটকে যাই।

নকশীকাঁথার মাঠ আমাকে এইরকম কষ্ট দিয়েছিলো। সাজুর বেদনা আামাকে আচ্ছন্ন করেছিলো এমনই। সাজুর সারাটা জীবন কেটে যায় একলা একলা… রূপাইয়ের প্রতীক্ষায়। কী দুঃসহ বেদনার প্রতিটি স্তবক!

আমি যদি কোনোদিন ভাবি, এক জীবনে আমার প্রিয়মুখের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে না দুচোখ আলিঙ্গনে; তখন আমার কি পাগল হয়ে যাওয়া উচিত হবে? এই অশ্লীল চ্যাট আর লাইভ ভিডিও’র কালসময়ে মানুষ কি এখনও ভালোবাসার মানুষের জন্য পাগল হয়? সারাটি জীবন অপেক্ষা করে? করে হয়তো…!

আজ থেকে শতবর্ষ পরে, টেকনোলজি যখন স্পেস ভেদ করে মহাশূন্যে উদ্দাম করবে, তখনও কি মানবপ্রজাতির নারী কিংবা পুরুষ পরস্পরের ভালোবাসার বিচ্ছেদে পাগল হয়ে যাবে? কিংবা দূরের কোনো নাক্ষত্রিক প্লানেটে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে? আর কোনোদিন ফিরবে না। নাক্ষত্রিক আলোকবর্ষ ভেদ করে একদিন হয়তো তার কাছে খবর পৌঁছবে— শি পাসড এ্যাওয়ে! ভালোবাসার মানুষটির কাছে কি তখন প্রিয়তমার কোনো স্মৃতিচিহ্ন থাকবে? নকশিকাঁথার মতো ভালোবাসায় এফোঁড় ওফোঁড় হওয়া স্মৃতিচিহ্ন, থাকবে না?