‘আমার এক চাচার কথা বলি।’ বলেই পিস্তল শাহ চিড়িক করে পানের পিক ফেলেন নয়নের দোকানের কাছড়ায়। তার এই পিক ফেলার দৃশ্য আমার অসহ্য লাগে। পানের পিক ফেললেই ঠোঁটের নিচের নিম দাড়িতে কয়েক ফোঁটা পানের রস চুইয়ে পড়ে। তিনি নিম দাড়িতে লেগে থাকা লাল টকটকে রস বাম হাতের চেটো দিয়ে মুছে সেটা পাছায় ঘষেন। ক্রমাগত রস মুছতে মুছতে তার লুঙ্গির এখানে সেখানে লাল দাগ দৃশ্যমান। যে কেউ দেখলে মনে করবে তার দীর্ঘকালীন রক্ত-আমাশা, নয়তো পাছায় খোস-পাঁচড়ার নীরব সংক্রমণ।

‘এই চাচা একবার এক পীর ধরলেন। এলাকার লোকাল পীর। পীরের অবস্থা ভালো। বাড়িতে বিল্ডিং, বিলে জায়গা-জিরাত কয়েক বিঘা। আমার চাচা মাঝে মাঝে পীরের বাড়িতে গিয়ে গান-বাজনায় শরিক হইতেন। চাচা ছিলেন মাস্টার মানুষ, শিক্ষিত লোক। কিন্তু মনের ভিতরে কেমনে জানি হান্দায়া গেছিল—কারো হাত না ধরলে পরপারে তরানোর উপায় নাই। চাচা তরানোর উছিলায় পীরের হাত ধরছেন।’

‘হাত ধরছেন মানে, মুরিদ হইছেন?’
‘হ মৌলভি সাব, হাত ধরা মানে মুরিদ হওয়া বা বয়াত হওয়া; যাই বলেন আপনে।’ বলেই তিনি আরেকবার পিক ফেললেন। আমি নিরিক ধরে তার নিম দাড়িতে লেগে থাকা পানের রসের দিকে তাকিয়ে আছি। পিস্তল শাহ কীভাবে যেন বুঝে গেছেন আমি তার এই রসারসি ব্যাপারটা পছন্দ করছি না। তিনি জিহ্বার আগা ঠোঁটের নিচে নামিয়ে দিয়ে নিম দাড়ির রস আবার মুখে টেনে নিলেন। মেজাজটা কেমন লাগে! এই শালার পীসসাবের চক্ষুলজ্জা বলতে কিছু নাই নাকি!

‘তো একদিন হইলো কী, চাচা বিলে গেছেন খেতের ধান কাটা দেখতে। খেতে রাজভোগের আবাদ করছেন। কামলারা ফজরের পরপরই ধান কাটতে শুরু করছে। তিনি তদারক করতে গেছেন। এমন সময় দেখেন, তার পীসসাবও বিলে আসছেন। বিলে তার জমি আছে, জমির ফলন দেখতে আসছেন। চাচা পীসসাবের দিকে আগায়া গেলেন। 
চাচাকে দেখে পীসসাব বললেন, ‘কী আফাজ মিয়া, রাজভোগ বুনছিলা মনে হয়?’
‘জি বাবা, ইবার রাজভোগ বুনছি।’ পীসসাবকে বাবা বলা নিয়ম। 
‘তোমার আম্মাজান খেতের রাজভোগ খুব পছন্দ করে। দোকানের রাজভোগ তো রাজভোগ না, দুই নম্বর চাইল মিশায়া রাজভোগ কয়া বেচে।’ বাবার কথায় আবদারের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আফাজ চাচা টের পায়।
‘কি যে বলেন বাবা, দোকানের রাজভোগ আর খেতের রাজভোগ কি সুমান? সব দুই নম্বরি। আমি খেতের পয়লট ধান ভাঙ্গায়া আম্মাজানের জন্য চাইল নিয়া যাবো।’
পীসসাব দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বাড়ির পথ ধরেন।

আমি বললাম, ‘গাছের প্রথম ফল, সবজির প্রথম ফলন, গাই বিয়াইলে পয়লা দুধ পীসসাবকে খাওয়ানোই তো রীতি ছিল একসময়। এই রীতি এখনও আছে নাকি?’
‘কী বলে! মহা সমারোহে আছে। পীসসাব যে পর্যন্ত গাছের পয়লা ফল না খাবে সে পর্যন্ত গাছের ফলে কাউকে হাত দিতে দিবে না। এগুলা তো ভক্ত-মুরিদির সাধারণ ব্যাপার।’
‘আচ্ছা, মাইন্ড কইরেন না। যারা কঠিন পীরভক্ত, তারা কি বিয়ে কইরা প্রথম রাত পীসসাবকে উৎসর্গ করে? এমন ঘটনা আছে?’ আমি মুখে একটা বোকা বোকা হাসি ধরে রাখলাম, যাতে প্রশ্নটা যে বোকার মতো হয়েছে সেটার সত্যতা ঠিক থাকে।
‘মৌলানা সাব, গ্রামে চোর ধরা পড়লে তারে জিকা গাছের ডাইল দিয়া কেন পিটায়, জানেন?’
‘জি না।’
‘জিকার ডাইল ওজনে ভারী এবং দেখতে গোলগাল। চোরের পাছা আর পিঠে বাইড়াইলে ব্যথা হবে কিন্তু দাগ হবে না।’
‘প্রথম রাতের সঙ্গে জিকার ডাইলের কী সম্পর্ক?’
‘আপনারে জিকার ডাইল দিয়া পিটাইতে মন চাইতেছে! বিটলামি বাদ দিয়া ঘটনা শোনেন।’

‘চাচা দিন দশেক পর সের পাঁচেক রাজভোগের চাইল নিয়া খুশিমনে পীসসাব বাড়ি গেলেন। পীসসাবের কদমবুসি কইরা চাউলের ব্যাগটা পায়ের কাছে রাইখা বললেন, ‘বাবা, আম্মাজানের জন্য খেতের রাজভোগের চাউল আনছি। আম্মাজান কবুল করলে অন্তরটা ভইরা যাবে। আম্মা-আব্বার অসিলায়ই তো খেতে চাইরটা ফসল হয়।’
পীসসাব চাউলের ব্যাগের দিকে তাকায়া চেহারায় রাজ্যের নাখোশি নিয়া আসলেন। তিনি হয়তো মণ-আধ মণ চাউলের আশা করছিলেন। পীসসাবকে দিতে হলে এর থেকে কম দিলে হয় নাকি? 
পীসসাব বিবিকে ডাক দিয়ে চাউলের ব্যাগ নিয়া যাইতে বললেন। ব্যাগ ধরে পাঁচ কেজির ওজন বুঝে বিবি সাহেবাও নাখোশি চেহারা নিয়া ভিতরবাড়ি চইলা গেলেন।

‘আফাজ চাচার মনটা দইমা গেল। খেতের পয়লট ধানের চাইল নিয়া আসছেন, হইক সের পাঁচেক, সেইটা তো ভালোবাইসা আনছেন। খেতে ধানই হইছে মোটমাট দেড় মণ। ভাঙ্গায়া মণখানি টিকছে। সেখান থিকা পাঁচ সের চাউল কি কম?
আফাজ চাচা থম মাইরা পীসসাবের পায়ের কাছে বইসা রইলেন কতক্ষণ। পীসসাব কথাবার্তা কিছু বলেন না। আফাজ চাচার শরীর বায়া রাগ উঠে। কিছুক্ষণ আরও বইসা থাইকা পীসসাবকে সালাম জানায়া চাচা পীরবাড়ির বাইরে আসেন। 

পীরবাড়ির বাইরে একটা উঁচু টিলার মতো, টিলায় বাঁশঝাড়। আফাজ চাচা টিলায় উঠে পীরবাড়ির দিকে কামান দাগিয়ে মুততে বসলেন। মুততে মুততে কসম করলেন—তোর রাজভোগ চাইলের পীরগিরির গোষ্ঠী কিলাই!’

আমি পিস্তল শাহ’র কথায় শেষমেশ হো হো করে হেসে উঠলাম।