বইটি এখনও পড়ছি। বিষয়বস্তুর বাইরেও লেখক দীনেশচন্দ্র সেন প্রাচীন বাংলার ধর্ম-অধর্ম, বিভিন্ন ধর্মের ট্রান্সফরমেশন, জাত-বেজাত, উগ্রপন্থা এবং বাংলায় উদ্ভূত নানা ধর্মের প্রসারণ ও অবলুপ্তির চমৎকার বয়ান তুলে ধরেছেন। ইসলাম তো বটেই, হিন্দু-বৌদ্ধ-নাথধর্ম-বৈষ্ণব-ব্রাহ্মসমাজ-চৈতন্যবাদ-সহজিয়ামত-কর্তাভজা বা এমন আরও নানা প্রকার ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা উদারতার সঙ্গে বয়ান করেছেন।

১৯৩৮ সালে গবেষক-লেখক দীনেশচন্দ্র সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষায় মুসলিমদের অবদান নিয়ে চারটি ধারাবাহিক গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এ বই সেই চারটি প্রবন্ধের সংকলন। বইয়ের নাম লেখকের নামানুসারে ‘প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ই উৎকীর্ণ করা আছে। 

বইটিতে বাংলার ‘একাভিপ্পায়ী’ নামের এক প্রকার ধর্মবিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। যার অনুসারীরা নারীকে ঈশ্বরের পূজ্য-অবয়ব মনে করত; মানে—ঈশ্বরের আরাধনা করার সর্বোচ্চ উপায় হচ্ছে নারীর প্রতি আরতি প্রকাশ করা, তাকে পূজনীয়ভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে ঈশ্বরের মোক্ষলাভ করা। বর্তমানে ইন্দো-বাংলা উপমহাদেশে বাউল-ফকিরদের কোনো কোনো ফেরকার মাঝে এমন বিশ্বাস এখনও বিদ্যমান পাওয়া যায়। প্রেমভাজা, কর্তাভজা, সহজিয়া—নানা নামে এর উল্লেখ করা হয়। 

বইটির কিছু অংশ পড়ার পর মনে হলো, ইউরোপ এবং আমেরিকায়; স্পেসিফিক বলতে গেলে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মাঝেও কিছু গুপ্ত কাল্ট সম্প্রদায় রয়েছে—যারা এভাবে নারীকে পূজ্য-অবয়ব বিশ্বাসের মাধ্যমে ঈশ্বরের তুষ্টি কামনা করে থাকে। ড্যান ব্রাউনের ‘দি দা ভিঞ্চি কোড’ বইটি যারা পড়েছেন তারা আমার কথার সঙ্গে একমত হবেন বলে আশা করি। ইলুমিনাতি বা এ ধরনের ধর্মীয় কাল্ট সম্প্রদায়ের কথা আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন, যারা খ্রিষ্টধর্মের নানা অপভ্রংশ রূপ থেকে জন্ম নিয়ে গুপ্ত সংগঠন হিসেবে প্রচার পাচ্ছে।

মজার ব্যাপার হলো, ইন্দো-বাংলার যে ‘একাভিপ্পায়ী’ সম্প্রদায়ের কথা এখানে বলা হয়েছে, তাদের অস্তিত্ব খ্রিষ্ট জন্মের তিনশ বছর পূর্বেও বর্ণিত পাওয়া যায়। পালি ভাষায় লিখিত ‘কথা-বত্থু’ নামক এক প্রাচীন পুস্তকে এই সহজিয়া মতবাদের কথা উল্লেখ আছে, যারা নারী-পুরুষের ঐকান্তিক আরাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরতুষ্টিতে বিশ্বাসী ছিল। এবং স্মর্তব্য, এই ‘একাভিপ্পায়ী’ বা সহজিয়া মতাদর্শীরা ছিলেন বৌদ্ধধর্মের অপভ্রংশ অংশ। 

হিন্দুধর্মের অপভ্রংশ অনেক সম্প্রদায়ও এমন মতবাদের ধ্বজা উচ্চে তুলে ধরেছে। যেমন শ্রী চৈতন্য উদ্ভূত বৈষ্ণবধর্ম। এ ধর্মেও নারীকে পূজনীয় বিশ্বাস করা হয়। ইন্দো-বাংলার বাউল সম্প্রদায় অনেকাংশে বৈষ্ণব মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত।

যা হোক, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন অপভ্রংশ সম্প্রদায় বাংলাদেশের ইসলাম সম্প্রসারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সে বিষয়ে আরেকদিন আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ! 

টীকা: 
বইটি প্রকাশ করেছে চট্টগ্রামের বাতিঘর। তবে বইটি ঈষৎ পরিমার্জনের দাবি রাখে। একে তো গবেষণা প্রবন্ধ, আবার চোস্ত সাধুভাষায় লিখিত। প্রাচীন বর্ণনার ক্ষেত্রে অনেক স্থানে বক্তব্য বেশ দুর্পাঠ্য। সাধুভাষা রেখেও এমন দুর্পাঠ্য বয়ানগুলো পরিমার্জন করলে বইটি আরও সুপাঠ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস। বাতিঘর এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে—এমন আশা রাখি।