প্রিয় মুজিব, তোমার চিঠি পেয়েছি। অনেক দিন পর কারো হাতে লেখা চিঠি পেলাম। শেষ কবে কে আমাকে চিঠি লিখেছিল, ভুলে গেছি। আমি কবে শেষ লিখেছিলাম, সে-ও মনে নেই। তবে জীবনে অনেক চিঠির কথা মনে আছে, যেগুলো আমি অনেককে লিখেছি, অথবা কেউ আমাকে। মোবাইল-ইন্টারনেটের এই যুগে তাই হঠাৎ হঠাৎ কেউ চিঠি লিখলে মন্দ লাগে না।

তোমার চিঠি হাতে নিয়ে ভাবছি শিমুলবাগের আফরোজার কথা। তুমি লিখেছো, কালো ভোমরার মতো তার ছিল আয়ত দুই চোখ, দীঘল কালো চুল, শ্যামলা গায়ের রঙ। অমনই ছিল হয়তো। যেহেতু আমি তাকে কখনো দেখিনি, কোনোদিন দেখবও না আর। তবু আমি কল্পনায় আফরোজার একটা অবয়ব দাঁড় করাতে চেষ্টা করছি বারবার। ব্যর্থ হচ্ছি। চিঠিতে জানিয়েছো, তুমিও খুব একটা ভালো করে তাকে দেখোনি কোনোদিন। কিন্তু কেন যেন এখন তাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, জানো। তুমি কি তার কোনো ছবি সংগ্রহ করতে পারবে? হয়তো বাড়িতে তার কোনো ফটোগ্রাফ আছে, বন্ধুদের কারো মোবাইলে তোলা গ্রুপ ফটো আছে, নিজের তোলা সেলফি আছে। ষোল বছরের একটা মেয়ের ছবি অতোটা আর অবলা নয় এখন। 

সত্যি করে বলো তো, তুমি কি আফরোজাকে কখনো দেখোনি? যদি না-ই দেখে থাকো তবে কেন সামান্য সময়ের পরিচয়ে তুমি আমাকে জানাতে গেলে তোমার পাশের গ্রামের আফরোজা নামের এক মেয়ের মৃত্যুসংবাদ? 

মুজিব, তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় এই তো মাস পাঁচেক আগে। কিশোরগঞ্জ গিয়ে তোমার মতো আরও অনেক তরুণের চোখ দিয়ে আমি প্রথম দেখেছিলাম আমাকে। মফস্বলের এক দঙ্গল ছেলে, যাদের কাছে সামান্য ভাবের কবি ‘ইয়া আফরোজা ইয়া আফরোজা’ নামে একটি পুস্তক লিখে বিরাট কবি হিসেবে দেদীপ্যমান। তোমরা আমার সামনে আসছো দলবেঁধে, হুড়োহুড়ি অবস্থা। আমি তোমাদের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছি, ঠাট্টা করছি, উপদেশও খয়রাত করছি। কিন্তু আমার হৃদয় আনন্দে কাঁদো কাঁদো। আর কেউ না হোক, পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ইয়া আফরোজা নামের এ প্রেমপুস্তক পাঠের যোগ্য মনে হয়েছে, ঢের ছিল ওই দিনের জন্য। 

তোমার সঙ্গে আলাদা কথা হয়েছে, ওই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই। তোমার সঙ্গে আরও অনেকেই ছিলো। কী আগ্রহ নিয়ে সবাই দাঁড়িয়েছিলাম, কথা বলছিলাম কবিতা নিয়ে, জীবন নিয়ে, আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে। কথা দিয়েছিলাম, আবার আসবো। তোমাদের সঙ্গে যাবো হাওড় দেখতে। বিরাট জলবিভূতির মাঝে নৌকা থামিয়ে ধ্যান করবো নিরালায়। বর্ষা আসছে, তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে কি-না, জানা নেই। 

প্রিয় মুজিব, তোমার চিঠিটা আমার হাতে এলো গত পরশু, তখন আমি লঞ্চযাত্রার তোড়জোড় শুরু করেছি। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ছেড়ে যাবে লঞ্চ, সাড়ে তিনটায় তোমার চিঠি পড়ে আমি নিশ্চল হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম নবপ্রকাশে। সপ্তাহখানেক আগে যখন তুমি আমাকে ফোন করে জানালে, ‘আপনার জন্য একটি দুঃসংবা আছে। পরে বলবো।’

আমি জোর করে বললাম, ‘বলে ফেলো, কী আসে যায়!’

তুমি হাসি লুকানোর চেষ্টা করে অপ্রস্তুত হয়ে বললে, ‘আমাদের পাশের গ্রামের একটি মেয়ে মারা গেছে মাসখানেক আগে। মেয়েটার নাম ছিলো আফরোজা। আপনার আফরোজার নামে নাম। তাই ভাবলাম বলি আপনাকে।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা বলো…।’ 

তুমি জানাও, ‘মৃগীরোগ ছিলো আফরোজার। একদিন বাড়ির পাশের নদীতে গিয়েছিলো গোসল করতে, একা একা। সঙ্গে কেউ ছিলো না। পানি আর আগুনে মৃগীরোগের যম। নদীর জলে হয়তো রোগটা হঠাৎই পেয়ে বসেছিলো। হাত-পা খিঁচুনি দিয়ে জলের মধ্যে কিছুক্ষণ দাপাদাপি করেছে, কেউ দেখেনি। নাক-মুখ দিয়ে জল ঢুকে ভরে গেছে ফুসফুস, আর দম নিতে পারেনি। জলের তলে তলিয়ে গেছে স্রোতের টানে। 

‘দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে সবাই যখন তাকে খুঁজতে বেরোয়, তখন একটা নৌকার খুঁটিতে পাওয়া গেলো তার গায়ের ওড়না। লাশটা পাওয়া গেলো একদিন পর, বাড়ি থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে বিলে, কচুরিপানা আর শ্যাওলার মধ্যে। ফুলে উঠেছিলো লাশটা। আফরোজাকে মাছেরা ঠুকরিয়েছে এখানে সেখানে। বিক্ষত। এবং… ’
এরপর তুমি আমাকে চিঠি লিখে বিস্তারিত জানালে আমাদের এই আলোচ্য আফরোজার চিন-পেহচান।

প্রিয় মুজিব, আফরোজা আমার প্রিয়তমার ডাকনাম নয়। এটা ওর পোশাকি নাম। ডাকনাম অন্যকিছু। তবু এই নামে সে পরিচিত। ‘ইয়া আফরোজা’র বদৌলতে তার নাম উৎকীর্ণ হয়ে গেছে কালের চৌকাঠে। 

প্রিয় মুজিব, তোমার চিঠি যেদিন পেলাম, সেদিন আমি বন্ধুদের নিয়ে আনন্দোৎসব করতে চলে গিয়েছিলাম চাঁদপুর। লঞ্চের ছাদে শুয়ে-বসে পাড়ি দিয়েছি বিস্তীর্ণ জলরাশি। বুড়িগঙ্গা থেকে ধলেশ্বরী, ধলেশ্বরী পার হয়ে মেঘনার দানবীয় বুকে রেখে এসেছি আমার চোখের বিমুগ্ধ আস্তিন। চাঁদপুর নেমে চলে গিয়েছি মেঘনা, ডাকাতিয়া আর পদ্মার মোহনা দেখতে। বন্ধুদের সঙ্গে গান গেয়েছি, কোরাসে সুর তুলেছি, হাসি আর উল্লাসে ছড়িয়েছি উচ্ছ্বসিত সুবর্ণরেণু। ফিরতি যাত্রায় লঞ্চের ডেকে বসে আমি দেখেছি মহৎ মেঘনার বুকে কীভাবে ধীরে ধীরে ভোর তার পেখম খুলে নীলাভ করে তোলে আকাশ আর জলের সঙ্গম। এবং আমি ভেবেছি আফরোজার কথা। আমার এবং তোমার। লঞ্চের রেলিং ধরে তাকিয়ে থাকা ফেনা তোলা জলের উত্তালে মনে পড়েছে আফরোজাকে। বিশাল নদীর বুকে নিঃসঙ্গ ভেসে যাওয়া কচুরিপানা দেখে মনে পড়েছে আফরোজার কথা। হুমহুম করে ডাকতে থাকা লঞ্চের ইঞ্জিনের ধোঁয়ামুখ দেখে মনে পড়েছে আফরোজাকে। শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকা ম্রিয়মান চাঁদ আর তারার পাশে দেখতে চেয়েছি আফরোজার মুখ। আমার এবং তোমার। নদীর প্রতিটা ঢেউ হয়ে গেছে আফরোজাময়। জলের বুকে লঞ্চের প্রতিটা পদক্ষেপ মনের মধ্যে তোলপাড় করে উচ্চারণ করেছে আফরোজার নাম। আমার এবং তোমার।

যে আফরোজা স্রোতের টানে চলে গেছে, আমি সেই স্রোতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্মরণ করেছি তার বিদেহী নাম।
প্রিয় মুজিব, শিমুলবাগের আফরোজা বেহেশতে আছে। আমাকে সে কোনোদিন দেখেনি, নামও শোনেনি। তবু দূর গগনের ওপারে যখন তার স্ফূরিত আত্মা জানবে, কোনো এক পাপীব্যক্তি নিছক কৌতূহলে বারংবার স্মরণ করছে তাকে; জেনে নিও-সে সুখী হবে। সে সবুজ পাখি হয়ে উড়বে কাননে কাননে। আর সব স্বর্গ-অপ্সরীদের ডেকে বলবে, আমি মরিনি, আমি মরি নাই… আমার কোনো মৃত্যু নাই।

পৃথিবীর সকল আফরোজা সুখী হোক, সুখী হোক…এপারে-ওপারে!
ভালো থেকো!

ইতি
তোমাদেরই সাজাভাই