আমার বন্ধুভাগ্য অসম্ভব রকম ভালো। সেই শৈশব থেকেই। আমার মনে আছে, আব্বার সেনাবাহিনীর চাকরির সুবাদে ছোটবেলায় আমার কয়েকটা বছর কেটেছে চিটাগাং ক্যান্টনমেন্টে। বয়স তখন পাঁচ-ছয়। সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি। আমার বন্ধুত্ব হলো এক মেজরের দু ছেলের সঙ্গে— রাজিব আর পলাশ। তারা আমার চে বয়সে ঢের বড়, সম্ভবত ফাইভ-সিক্সে পড়তো। তবুও বন্ধুত্ব হলো। দুই ভাই ছিলো দুই স্বভাবের—পলাশ চশমা পরতো, একটু চাপা স্বভাবের। রাজিব ছিলো দারুণ রগচটে, চঞ্চলমতি। কিন্তু দুজনের সঙ্গে আমার সদ্ভাব ছিলো সমানতালে। আমার চে বয়সে বড়, এমন লোকদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব দ্রুত হওয়ার রাশিচক্র আছে সম্ভবত!

ক্যান্টনমেন্ট কোয়াটারের পূর্ব পাশেই ছিলো পাহাড়, কতোদিন পাহাড়ে গিয়েছি দল বেঁধে। নাম না জানা নানা রঙের বুনোফুল নিয়ে আসতাম পাহাড় থেকে। ওদের একটা পোষা কুকুরের বাচ্চা ছিলো, সেটাকে ‘ট্রেনিং’ দিতে পাহাড়ে উঠার কসরত করাতাম। পাহাড়ে চড়লেও দূরের পাহাড়ে যাওয়া আমাদের জন্য ছিলো দারুণ ভয়ের। আমাদের তখনকার বিশ্বাস ছিলো— দূরের পাহাড়ে চাকমারা থাকে। তারা সঙ্গে করে সবসময় দা রাখে। বাঙালিদের দেখলেই তারা দা’র কোপে গলা আলাদা করে ফেলে। আর বাচ্চাদের দেখলে তো কথাই নেই, একদম দু টুকরো। কোপাকুপিতে খুব নাকি হিংস্র ওরা। তখন আমাদের ভয়ের অন্যতম উপকরণ ছিলো চাকমা। দূর থেকে চাকমা নারীদের দেখতাম, পাহাড় থেকে লাকড়ি কেটে মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। পিঠে বাঁধা দুধের বাচ্চা, হাতে ধরা থাকতো দা। ওদের দেখেই আমরা পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়তাম।

আমাদের আরেকটা এক্সাইটিং কাজ ছিলো গুলি সংগ্রহ করা। ক্যান্টমেন্টের পাশের পাহাড়ের পাদদেশে আর্মির লোকজন ফায়ারিং টেস্ট করতো। টেস্টিং ফায়ারের গুলিগুলো ফায়ারিং রেঞ্জ পার হয়ে পাহাড়ের গায়ে লাগতো। ফায়ারিং শেষ হলে আমরা সেসব গুলির পুরনো কার্তুজ তুলে আনতাম। জংধরা কার্তুজ সংগ্রহের বাতিক ছিলো তখন। আরও অনেক স্মৃতি, অনেক স্মৃতি ভুলেও গিয়েছি।

ক্লাস টুতে পড়ার সময় চিটাগাংকে বিদায় দিয়ে বাড়ি চলে আসি। তবে এই বন্ধু দুজনের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। তারা এখন কোথায় আছে জানি না। আমার কথা কি তাদের মনে পড়ে?

দুই

এরপর গ্রামের স্কুল, স্কুল থেকে হেফজখানা, মাদরাসা-ইউনিভার্সিটি-জীবনের কর্মময় অধ্যায়… অসংখ্য ভালো বন্ধু পেয়েছি। আমার হেলাফেলার জীবনে এদের অবদান অসীম। নাম উল্লেখ করে এদের অবদানকে স্বীকার করার কোনো মানে নেই। এদের অবদান অস্বীকৃত। সব জিনিসের স্বীকৃতির প্রয়োজন হয় না পৃথিবীতে।

আমি যখন একা একা জীবনের কথা ভাবি, দেখি— আমার জীবনে কোনো খেদ নেই। জীবনে আমি যা হতে চেয়েছি ঠিক তা-ই হয়েছি। আমি যা দেখতে চেয়েছি তা-ই দেখতে পেয়েছি। যেভাবে ভালোবাসাতে চেয়েছি, যেভাবে ভালোবাসা পেতে চেয়েছি— ভালোবাসা ঠিক সেভাবেই আমাকে গড়ে নিয়েছে। What a Wonderful Life that’s I Lives…! সৃষ্টিকর্তাকে মাঝে মাঝে চুমু দিতে ইচ্ছে করে!

তবে আমার বন্ধুদের মধ্যে বিখ্যাত কেউ তেমন একটা নেই। আমি বিখ্যাত ব্যক্তিদের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি। এমনিতে আমিও অনুল্লেখ ব্যক্তি, চেষ্টা করি নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতে। জীবন মদের সোরাহি নয় যে হুল্লোড় করে মচ্ছবে বিলিয়ে দিতে হবে। আমার কাছে জীবন পাখির মতো স্বাধীনতার নাম । অতি সাধারণ করে বাঁচতে চাই। হাততালি-শানদার-জিন্দাবাদে আমার তেমন সমীহ নেই। বৃষ্টি, সবুজ, পাখির ডাক, বাসের ভেঁপু, পরিবার, ছোট গৃহকোণ, লেখালেখি, প্রিয়তমা… সব মিলিয়ে ভরপুর এক জীবন।

তিন

অনলাইনের বন্ধুত্ব একেবারেই ঠুনকো…। আসলেও কি তাই? এখন আর তেমনটা মনে হয় না। ২০০৮ থেকে ব্লগ, ২০০৯ থেকে ফেসবুক— অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। সবচে লাভের বিষয় হলো, অনলাইন বন্ধুত্ব অটুট রাখার বেশ অমূল্য একটা মাধ্যম। বহুদিন দেখা সাক্ষাত নেই তো কী হয়েছে? অনলাইনে ঠিকই বাতচিত হচ্ছে হররোজ। সম্পর্ক ঝালিয়ে নেয়া যায় মুহূর্তেই।

ফেসবুকে জন্মদিনে উইশ করাটা আমার তেমন পছন্দের না। আমি কাউকে করি না, আগে কাউকে কাউকে করতাম, এখন একেবারেই বাদ দিয়ে দিয়েছি। কারো কাছ থেকে নিজের জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাওয়াটাও বিরক্তিকর লাগে এখন। যারা আজকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, তাদের ভালোবাসাকে সম্মান জানাই। শুভেচ্ছা জানানো আপনার প্রযুক্তিক অধিকার, আমার পছন্দ হলো কি হলো না সেটা নিয়ে আপনার না ভাবলেও ধরণীর কিছু যাবে আসবে না।

চার

বন্ধুত্ব নিয়ে আমার খানিকটা দুঃখবোধ আছে। আমার এমন কিছু বন্ধু আছে যারা জীবনের কর্মক্ষেত্রে অসফল। জীবনে অসফল— এমন কিন্তু আমি বলছি না। হয়তো পড়ালেখাটা ঠিকমতো শেষ করতে পারেনি বিধায় এখন নিচু মান ও কম আয়ের কোনো কাজ করে। এমন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে আমি এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগি। কেন ভুগি— সেটা নিজেও জানি না। জাস্ট একটা অপরাধবোধ কাজ করে ভেতরে ভেতরে।

এক বন্ধুর কথা বলি। তার বাড়ি আমার শশুরবাড়ির কাছে। শশুরবাড়ি গেলে মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়। ও যেনো অস্বস্তিতে না ভুগে, এ কারণে আমি ওর সঙ্গে সেই ছোটবেলার মতোই তুই-তোকারি করে কথা বলি। আমার সঙ্গে হেফজখানায় পড়েছে। হাফেজও হয়েছিলো সম্ভবত। এখন অটোরিকশা চালায়।

সেদিন শশুরবাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে আসবো। পনেরো-বিশ মিনিটের পথ, অটোরিকশায় আসতে হবে। স্ট্যান্ডে ও ছাড়া আর কোনো অটো দেখলাম না। অন্য কোনো অটো থাকলে ওর অটোতে আমি চড়ি না। এটা আমার জন্য বিব্রতকর, ওর জন্যও হয়তো। আমি নিজেকে এবং ওকে শুধু শুধু বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাই না পারতপক্ষে। কিন্তু সেদিন অন্য কোনো অটোরিকশা ছিলো না, আমারও বাড়িতে এসে জুমার নামাজ পড়ার তাড়া আছে। অগত্যা ওর দিকেই এগিয়ে গেলাম।

অটোতে চড়ে আসার সময় ও ওর ছেলেমেয়ের কথা বললো। জানালো, বড় মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে, ক্লাসের ফার্স্টগার্ল। ভালো ছাত্রী বলে মেয়েকে এটা সেটা অনেক কিছু কিনে দেয়, হরলিক্স-ডিম-দুধ কিনে দেয়… সেসব ফিরিস্তি শোনালো। মেয়েকে ভালোভাবে পড়ানোর ব্যাপারে আমি ওকে উৎসাহ দিলাম। ছোট মেয়ের কথাও বললো। বললো বউ কীভাবে সংসারে উন্নতি করছে, সে ব্যাপারেও। আমি মোহিত হলাম। সত্যিই কি কি মোহিত হলাম, নাকি ভেতরে ভেতরে দুঃখিত হলাম?

আমি জানি, ও আমাকে ওর মেয়ে ও স্ত্রীর সফলতার গল্প শুনিয়ে হয়তো বুঝাতে চাচ্ছে— আমি খুব খারাপ নেই। আমি এই অটোরিকশা চালালেও আমার মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হচ্ছে, আমার বউ সংসারটা ঠিকই আগলে নিয়ে বেশ সুখেই রেখেছে আমাকে। তোমরা হয়তো লেখাপড়া করে বড় দিগ্গজ হয়েছো, আমি কিন্তু খারাপ নেই। আমি বেশ সুখেই আছি…!

হয়তো ওর কথাই ঠিক, ও-ই সুখে আছে। আমরা বড় বড় বই হৃদয়স্থ করে আর অনলাইনে তাবৎ দুনিয়ার খবর রপ্ত করে বিরাট জ্ঞানদার হয়ে গেছি। জীবনের আসল সুখটা হয়তো ও-ই একা একা ভোগ করছে। আমরা কেবল সুখের নানা রকম সংজ্ঞা যাচাই করে দেখছি, কোনটা সুখ আর কোনটা গরল। ও জীবন দিয়ে পরখ করে ফেলেছে— সুখ আসলে কাকে বলে!

আমার সকল জ্ঞাত-অজ্ঞাত বন্ধুর অসম্ভব সুখী জীবনের প্রতি…