আজ পুরনো বন্ধু হামিদুল্লাহর সঙ্গে দেখা হলো। তাও বছরখানেক পর। দেখা হতেই বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
ওর সঙ্গে আমার অনেক মধুর স্মৃতি আছে। অসম্ভব সহজ সরল হামিদুল্লাহ আমার চে দু ক্লাস নিচে পড়লেও ওর সঙ্গে ছাত্রাবস্থায় তিন-চার বছর তারাবি পড়িয়েছি। ওর পরিবারের সঙ্গেও বেশ খাতির ছিলো একসময়। অনেকবার গিয়েছি নবীনগর স্মৃতিসৌধের পাশে ওদের বাসায়। ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যস্ততার কারণে এখন আর সখ্যতাটা সেরকম নেই। তবু অনেকদিন পর বন্ধুর দর্শন, বুকে না নিয়ে পারা যায়!

ওকে বুক থেকে ছাড়তেই বললো, আমার ছেলেটা মারা গেছে! শুনেছো?
হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, না তো! কীভাবে? বয়স কতো হয়েছিলো?
—দু বছর এক মাস। এই তো মাস দেড়েক আড়ে, বাসার পাশে একটা ডোবার মতো ছিলো। খেলতে গিয়ে…!

আমি হামিদুল্লাহকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ওকে সান্ত্বনা দিতে পারবো, এমন কোনো নীতিবাক্য আমার জানা নেই। তাই অনেকটা সময় নিয়ে ওকে ধরেই রাখলাম।

আজকে পুরনো বন্ধুদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠান ছিলো। অনুষ্ঠানের মাঝে যতোবার হামিদুল্লাহর দিকে চোখ পড়েছে, সেখানে আমার বন্ধু হামিদুল্লাহকে দেখিনি। দেখেছি কেবল একজন সন্তানহারা পিতার মুখ। একজন সন্তানহারা পিতা গভীর বেদনা নিয়ে হাঁটছে, খাচ্ছে, কথা বলছে, সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করছে। যার দু বছরের প্রথম সন্তান মারা গেছে কিছুদিন আগে!

আমি প্রিয়বন্ধুর এই বেদনা কেমন করে লাঘব করবো!!

০২
সপ্তাহ দেড়েক পর বাড়িতে এলাম। রাতের খাবার সময় আমাদের বিড়ালটা হাজির থাকে সবসময়। আজকে ও হাজির হতেই মা বললো, ও কয়েকদিন আগে বাচ্চা দিয়েছিলো ও পাড়ায়। ও পাড়ার লতিফ ভাই ওর বাচ্চাগুলো কোথায় যেনো ফেলে দিয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে আর পাইনি।

আমি ওর দিকে তাকালাম। চোখের কোণে জলের দাগ। স্তনগুলো ফুলে আছে দুধে। দুধ খাওয়ানোর সন্তান নেই। ভাবলাম, বিড়ালেরও কি সন্তান হারানোর বেদনা হয়? ওরও কি হামিদুল্লাহর মতো সন্তানহারা কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতর?

ওর বাটিতে মাখা ভাত দিলেন আব্বা। অর্ধেক খেয়ে আর খেলো না। চুপচাপ একদিকে বসে রইলো।

ও মাঝেমাঝে ডাইনিং টেবিলে রাখা তরকারির বাটি থেকে মাছের টুকরোটা খেয়ে ফেলে, ভাতের বাটিতে মুখ দেয়, মিটশেলফ খোলা থাকলে সেখানে হানা দেয়। তখন ওর সঙ্গে রাগ করি। বকাবকি করি ওকে। পিটুনি দেয়ার চেষ্টা করি। ও দৌড়ে পালায়। আবার যখন খেতে বসি, তখন ঠিকই ওকে খুঁজি। মাকে জিজ্ঞেস করি, বিড়ালটাকে দেখছি না যে! কই দেখো তো, একটু ডাক দাও ওকে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি আমার রুমে এসে শুয়েছি, একটু পর ও-ও বিছানায় উঠে এসেছে। আমার কোনো অনুমতির তোয়াক্কা করেনি, আমার পা ডিঙিয়ে বুকের কাছে এসে শুয়ে পড়েছে। উষ্ণতার জন্য? নাকি বেদনা লুকাতে?

এক বুকে একই দিনে দুজন সদ্য সন্তানহারার বেদনা আমি কেমন করে আগলে রাখি?

ও এখন চোখ বন্ধ করে বুকের কাছে শুয়ে আছে। বুকের উম নেয়ার চেষ্টা করছে। একটু পরপর ওর ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। ও মিউমিউ করে এদিক সেদিক দু-একবার তাকিয়ে আমার বুকের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ছে। আমি ওর উষ্ণ শরীরের উত্তাপ টের পাচ্ছি।

ও কি বুঝতে পারছে, কী বেদনা নিয়ে আমি ওর জন্য এই লেখা লিখছি?