‘ও হে সকালের বাতাস তুমি কোথায় চলে যাও,
মদিনার খুশবু তুমি আমায় দিয়ে যাও।’

মদিনার খুশবু। কেমন হয় মদিনার খুশবু? একজন মানুষের স্পর্শে পুরো একটি শহর খুশবুদার। আহা! কি সেই খুশবুর কাঁচামাল? একজন মানুষের জন্মে একটি সম্প্রদায় সম্মানিত। পুরো একটি জাতি নিজেদের নামের সাথে জুড়ে নিয়েছে তার নামের পরশমণি।

মুহাম্মদ। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের মদিনা। তাই মদিনা খুশবুদার। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরব ছিলেন। আরবদের সশ্রদ্ধ সালাম।

মুহাম্মদ নাম মুহাম্মদি মানুষের পতাকা। ইসলামের ব্র্যান্ড লোগো। এ কারণেই কি পাসপোর্টে মুহাম্মদ নামের উপর লালকালি? রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এ নাম কালো তালিকাভুক্ত? নামধারীরা সন্ত্রাসী?

তবুও এ নামের খুশবু অপ্রতিরোধ্য। মনুষ্য জিঘাংসার তীক্ষ্ম সকল কাঁটাতার ভেদ করে এ নামের খুশবু আমাদের মোহিত করে, আচ্ছন্ন করে। আমরা আচ্ছন্নতার পর্দার ভেতর থেকে উচ্চারণ করি—
আয় মরুপারের হাওয়া, নিয়ে যারে মদিনায়
জাতে পাকে মোস্তফার রওজা মোবারক যথা।
… কাঁদব মাজার শরীফ ধরে,
শুনব সেথায় কান পাতি,
হয়ত সেথা নবির মুখে রব উঠে ‘য়্যা উম্মতি’!
[কাজী নজরুল ইসলাম]

মুহাম্মদের নামে কালি, কালিমা। তাতে মুহাম্মদের কিইবা ক্ষতি? কিংবা মুহাম্মদি উম্মতের! কুরাইশরা তো মুহাম্মদের মুখেই চুন-কালি মেখে দিয়েছিলো। তার নামের কুৎসা গেয়ে বেড়াতো মক্কার কবিকুল। পথে-পথে, হাটে-বাজারে, হজ্জের মাহফিলে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম রাস্তায় হাঁটলে মহিলারা আবৃত্তির সুরে বলে উঠতো— ‘যাচ্ছে একটা আস্ত পাগল, মাথা খারাপ লোক’।

আবি তালিব গিরিপথে কেটেছে মুহাম্মদের দুর্ভিক্ষের দিন। সমাজচ্যুত। এরপর জন্ম আবাস ত্যাগ। মদিনার পথে।

এই সেই মদিনা। মুহাম্মদের পরশে ইয়াসরাব থেকে মদিনাতুন নবি। যেখানের খুশবুকাতরতা আমাদের আজীবনের। মক্কার কুৎসা, মক্কার ব্যাঙ্গ, মুহাম্মদকে হেনস্থা করতে কুরাইশদের হীন চক্রান্ত—কিছু কি পেরেছে মুহাম্মদ নামের ঔজ্জ্বল্য ম্লান করতে? বরঞ্চ সেই কুৎসাকারীরাই একসময় গেয়েছে মুহাম্মদ নামের স্তুতি পদাবলি।

হাসসান ইবনে সাবিত। কী ভয়ঙ্কর এক কবিই না ছিলেন তিনি মক্কার। মুহাম্মদের নামে অনর্গল তুবড়ি ছুটতো তার মুখে। অথচ শেষে? লিখলেন অবিনশ্বর এক কাসিদামালা—কাসিদায়ে হাসসান ইবনে সাবিত।
‘ওয়া আহসানা মিন কালাম তারাকত্তু আইনুন,
ওয়া আজমালা মিন কালাম তালিদিন নিসা-উ,
খুলিকতা মুবাররাআম মিন কুল্লি আইবিন,
কাআন্নাকা ক্বাদ খুলিকতা কামা তাশা-উ …’।

‘আমার দু’চোখ তোমার চেয়ে সুন্দর কাউকে দেখেনি কখনো
কোনো রমণী তোমার চেয়ে সুন্দর কাউকে প্রসব করেনি
সর্ব প্রকার ত্রুটিমুক্ত করে তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে
যেন তুমি যেমন ইচ্ছে তেমনই সৃষ্টি হয়েছো।’
[হা মীম কেফায়েতের তর্জমা]

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের শামায়েল এর চেয়ে নিপুণ নমুনায় আর কেউ বর্ণনা করতে পারেনি।

তাহলে, কালির রঙ লাল কিংবা কালো হোক—শঙ্কার কী? ধুলিস্যাৎ মানচিত্র পাহারা দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে যারা, তাদের কলজের ভেতর শঙ্কার কোনো আভিধানিক অর্থ থাকা কাপুরুষতা।

আমি যদি আরব হ’তাম মদিনারই পথ,
সেই পথে মোর চলে যেতেন নুর-নবি হজরত।

তবুও মদিনা। কাজী নজরুল ইসলামের মদিনা। মদিনার পথ। মুহাম্মদের হেঁটে যাওয়া পথ। মুহাম্মদের পায়ের ধুলো। কী সৌভাগ্য তাদের! সৌভাগ্য নজরুলের। এমন পঙক্তি…। সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।

শুনেছি, আল্লামা শেখ সাদি রহ. ইন্তেকালের পর তার এক নিকটজনকে স্বপ্নে বলেছিলেন, তার জীবনের এতো জ্ঞান সাধনা, পরহেজগারি কিছুই আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়নি। শুধু চার লাইনের একটি কাসিদা—
বালাগাল উলা বিকামালিহি
কাশাফাদ দুজা বিজামালিহি
হাসুনাত জামিউ খিসালিহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি

চার লাইনের বদলে বেহেশত। আহ, কী খোশ কিসমত। এমন কাসিদা…।

জানি না বেহেশতে যাওয়ার জন্য একটি পঙক্তির ভেতর কতোখানি মুহাম্মদ-বেকারারি প্রয়োজন হয়; জানি না নজরুলের ভেতর মুহাম্মদের পথ হওয়ার কতোটুকু আকুতি ছিলো; কেবল জানি, মদিনার পথ, মুহাম্মদের হেঁটে যাওয়া পথ হতে বড় সাধ জাগে মনে। কমছে কম আরবের কোনো পথ।

না, আরবের সব পথ না। আরবের অনেক পথে এখন মার্কিনিরা হাঁটে। মার্কিন সেনা। বুটপরা পা, পায়ের তলায় রক্তের গন্ধ। মানুষের রক্ত। সিরিয়া, ইরাক, আফগান, ভিয়েতনাম, জাপানের মানুষের লাল রক্তের ছাপ। এতো নিরপরাধ মানুষের রক্তের গন্ধ আমার সইবে না। আমার সহ্য ক্ষমতা কম।

কেবল মদিনার পথ। মদিনায় কি মার্কিনিদের প্রবেশাধিকার আছে? হয়তো আছে। ওবামাও আরবে যায়। ট্রাম্পও আরবে যায়। খুনপিয়াসির জায়েজ উত্তরসূরি ওবামা-ট্রাম্প।

ওবামা কি মদিনায়ও ‘তাশরিফ’ এনেছিলো? হায় নবি! তাহলে আমি আর কোন গলির পথ হবো?

আমি তবে ধুলো হই। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে যে ধুলো মুহাম্মদের আগমনে অপেক্ষমাণ। হাওয়া এলে যেখানে খুশি উড়ে যাবে সে। মুহাম্মদের পায়ের ধুলো। মদিনার অলি গলি। উড়ে উড়ে আমি কেবল গেয়ে বেড়াবো—
কদম তার লাগতো এসে আমার কঠিন বুকে,
আমি ঝর্ণা হয়ে গ’লে যেতাম অমনি পরম সুখে।
সেই চিহ্ন বুকে পুরে—
পালিয়ে যেতাম কোহ্-ই-তুরে,
সেথা দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারত।
…মদিনারই পথ।
[কাজী নজরুল ইসলাম]

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি চত্বরে পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একশ’জন মহামানবের নামে ফলক খচিত রয়েছে। সেখানে সর্বপ্রথমে রয়েছে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের নাম।

অক্সফোর্ড মানে বৃটেন। পাশ্চাত্য। পাশ্চাত্যের মানুষের কাছে মুহাম্মদ কে? ফলকে শোভিত ঐতিহাসিক নামবিশেষ নাকি সন্ত্রাসী?

পাশ্চাত্যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সন্ত্রাসী হলো কবে থেকে? উম্মতে মুহাম্মদি চিহ্নিত হচ্ছে কবে থেকে? সম্ভবত গত শতকের শেষ থেকে। টুইন টাওয়ার ঘৃতাহুতি। যদি মুহাম্মদিরা করেই থাকে তাহলে লাভবান হলো কে? মুহাম্মদিরা তো নয়। তামাম দুনিয়ার সবলরা তাদেরকে তিলে তিলে মারছে। কারো কারো ঘরে ঢুকেই মারছে।

মুহাম্মদ নাম ডেনমার্কে, ইতালিতে, সুইডেনে ক্রুশবিদ্ধ। ‘মুসলমান’ শব্দ আর পাশ্চাত্য সাপ-নেউলে। পাশ্চাত্যের দিকে বড় চোখ করে তাকালেই সোজা ধরে নিয়ে যায় ম্যানহাটন। যে অক্সফোর্ডে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম শ্রেষ্ঠ সেখানে হিজাব সাম্প্রদায়িক। অকারণে তো নয়। যদি মুহাম্মদিরা কারণ হয় তাহলে আমরা মুহাম্মদকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জবাব চাই তাদের কাছে যারা মুহাম্মদের নাম অস্ত্র বানিয়ে মুহাম্মদকে সন্ত্রাসী বানিয়েছে।

দু‘শত শায়খুল হাদিস লিখবেন দু‘শত সিরাত রচনা। দু‘শত সিরাত রচনা দিয়ে একটি পরিপূর্ণ সিরাতগ্রন্থ। বাংলা ভাষায় রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ সিরাতগ্রন্থ। সর্ববৃহৎ সিরাতে মুহাম্মদি।

একটি ভাবনাকল্প। অনেকদিন আগে বিশিষ্ট কলামিস্ট মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন সিরাত বিষয়ে একটি কলামে লিখেছিলেন—বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় আজ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্যবহুল কোনো সিরাত গ্রন্থ লেখা হয়নি।

লেখাটি পড়ার পর আফসোস হয়েছিলো। নিজেদের কৃতঘ্নতা দেখে নিজের কাছেই অবাক লেগেছিলো। একটি ভাবনার জন্ম হয়েছিলো তখন। আর কার কার মধ্যে জন্ম হয়েছিলো, জানি না। তবে আশায় আছি, খুব শিগগির ভাবনাকল্পের বাস্তবতা দেখবো।

অন্তত দেখা উচিত। মুহাম্মদ ছাড়া আর কী আছে মুহাম্মদি উম্মতের? না দুনিয়ায় না ওপারের। সিরাত নিয়ে কতো কী হয় এ দেশে। সিরাত কমিটি, সিরাতুন্নবি, সিরাত মাহফিল আরো নানান কিছিম। তাহলে একটি সিরাত গ্রন্থ কেন নয়?

বুকের মাঝে যা আছে সুতীব্র অহঙ্কার তার সবটুকুই তোমার দেয়া, হে নবি। যতো যাতনা আমার তা-ও তোমার বিহ্বলে রচিত। মাঝে মাঝে ভাবি, কী করে পারলে তুমি হতে এতোটা সর্বকালীন! কেমন করে এতোটা সার্বজনীন তুমি!

তোমার প্রতিটি আদেশের গুঢ়তা আমাকে অহঙ্কারী করে। এ অহঙ্কার জাহান্নামের উপাদান হলে, তথাস্তু। তোমার নিষেধ আমাকে তোমার প্রেমিক করে। তোমার ভালোবাসা আমাকে কেবলই ভালোবাসতে শেখায়। একদিন ভালোবাসতে বাসতে আমি ঘৃণা ভুলে যাবো। আমাকে তুমি অতোটুকু ভালোবাসার অবসর দাও।

কে আমি’ জানালে তুমিই প্রথম হে মেষ-পালক উম্মী নবি।
দীপ্ত সূর্য আলো আরশিতে ধরিয়েছে কাল তোমার ছবি।
সে এল সে এল রাজার মতো সে এ ধূলিতে তবু দীনের মতো,
পুষ্পকোমল তার অন্তর হলো বিক্ষত কাঁটায় ক্ষত,
তবু সে জাগাল মেশকের বাস, জাগাল মরুতে গুলেআনার
ইব্রাহিমের পরশে যেমন ফুল হয়ে ফোটে ক্ষুব্ধ নার।
[ফররুখ আহমদ, সিরাজাম মুনীরা]