আমাদের পাড়ার মসজিদে ইমাম সাহেব ছিলেন এক তরুণ হুজুর। কাছেই এক মাদরাসায় জালালাইন-মিশকাত পড়তেন আর আমাদের মসজিদে ইমামতি করতেন। ছেলে হিসেবে ভালো। তো, তরুণ হওয়ার দরুণ যা হয়, পাড়ার কিশোর-তরুণ পোলাপানের সঙ্গে তার ভালো দহরম-মহরম হয়ে গেল। তাদের সঙ্গে বিকেলে হাঁটতে যান, একসঙ্গে ক্রিকেট খেলেন, ব্যাডমিন্টন খেলেন, মোবাইলে গজল-টজল শেয়ারিং করেন। মোটমাট, পোলাপানের সঙ্গে তার বেশ খাতির হয়ে গিয়েছিল আর কি!

সবাই ভাবছেন, এই হুজুর তো শ্যাষ। নিশ্চয় কোনো বদনামির কেচ্ছা আসছে সামনে। 

না জনাব! এই হুজুর যখন পোলাপানের সঙ্গে আসরের পর হাঁটতে যেতেন, মাগরিবের নামাজের জন্য তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আসতেন। নিজের টাকায় র‌্যাকেট কিনে খেলতেন। যারা আসরের নামাজ পড়বে না তাদের ব্যাডমিন্টন খেলতে দেয়া হবে না। খেলার পর যারা মাগরিবের নামাজে শরিক হবে না, পরদিন তাদের খেলায় নেয়া হবে না। সমবয়সী এবং একসঙ্গে থাকার কারণে এসব পোলাপানের ওপর তার আলাদা অধিকার ছিল। তিনি নামাজের কথা বললে কেউ না করতে পারত না। যে না করত, সে বেশ বিনয়ের অবতার সেজে না করত। 

করিৎকর্মা হুজুর। ইলেকট্রিকের কাজ-টাজও মোটের ওপর জানতেন কিছু। মসজিদের ফ্যানের সুইচ জ্বলে গেছে, আইপিএসে লাইন আসছে না, মাইকের সাউন্ড কম—হুজুর নিজেই ঠিক করে ফেলতেন। মুসল্লিদের কারো বাড়িতে এমন সমস্যা হলে তিনি স্বউদ্যোগে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে দিয়ে আসতেন। এলাকার মানুষের ওপর তার প্রভাব ছিল বাড়ির ছেলের মতো। তিনি কিছু চাইলে কেউ না করতে পারতো না। 

এই হুজুরটা এ বছর দাওরা পড়তে ঢাকার একটা মাদরাসায় ভর্তি হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে, আমাদের মসজিদে তরুণ মুসল্লির সংখ্যাও কমে গেছে।

যে কথা বলতে চাচ্ছি। আপনি এলাকার ইমাম সাহেব, আপনি মাদরাসার শিক্ষক, আপনি মাদরাসার ছাত্র—তার মানে এই না যে আপনি সমাজবিচ্ছিন্ন কেউ। আপনি এই সমাজেরই একজন। এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একজন। আপনি আলেম বা হুজুর হওয়ার দরুণ সমাজের এমন এক স্থানে অবস্থান করছেন, একটু উদ্যোগী হলেই অনেককে প্রভাবিত করতে পারেন। হুজুর হয়েছেন বলে আপনি রাস্তা দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে যাবেন, এটা হুজুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়। এই সমাজ আপনার মুখাপেক্ষী। আপনি যদি অহংকার বা হীনম্মন্যতার দরুণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন, সে দায়ভার আপনার। 

সাধারণ মানুষকে আমরা বলি ‘জেনারেল লাইনের লোক’। কারা জেনারেল? তাকিয়ে দেখুন, যাদের আমরা জেনারেল বলে অবজ্ঞা করছি, তারা আমাদেরই বাপ-ভাই, চাচা-দাদা, বন্ধু-আত্মীয়। আমাদের চারপাশের পঁচানব্বুই ভাগ লোকই জেনারেল। আপনি যে সমাজের হুজুর হয়েছেন, এরা সে সমাজের বাইরের কেউ নন। তাদের অনেক অধিকার আছে আপনার ওপর।তাদের সকল ভালো কাজে শরিক হওয়ার দায়িত্ব আপনার। একজন আলেম বা ইমাম হওয়ার কারণে গ্রামে-মহল্লায় যে কোনো সমস্যা সমাধানে সবার আগে আপনার এগিয়ে আসা উচিত। তবেই আপনি সত্যিকারের ইমাম হতে পারবেন, সত্যিকারের আলেম হতে পারবেন। সমাজের মানুষ আপনার মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য। 

আমরা অনেকেই অভিযোগ করি, জেনারেল সমাজ হুজুরদের দাম দেয় না, তারা হুজুরদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। সেটা করার তো যথেষ্ট কারণ আমরা নিজেরাই তৈরি করে রেখেছি। আপনি যদি সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল পুলসিরাত আর কবরের আজাবের বয়ান করেন, তাদের ভালো-মন্দের খোঁজ না নিয়ে কেবল মাদরাসার চাঁদা কালেকশনের সময় তাদের দুয়ারে হাত পাতেন, তারা কীভাবে আপনাকে সম্মানের আসনে বসাবে? তাদের সুখে-দুঃখে আপনি তাদের সমব্যথী না হলে তারা কেন আপনার প্রয়োজনে আপনার পাশে দাঁড়াবে?

এই পৃথিবীতে তাদেরও একটা জীবন নিয়ে চলতে হয়। সে জীবনে প্রতিদিন তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। তাদের সেসব সমস্যা আপনি দূরে দাঁড়িয়ে দেখবেন, আর তারা আপনাকে আহ্লাদে বুকে টেনে নেবেন—এমন ভাবাটা বোকামি ছাড়া আর কী হতে পারে! গায়ে জুব্বা, মাথায় রুমাল, বগলে আতরের ঘ্রাণ নিয়ে আপনি নিজেকে সমাজের ঊর্ধ্বের কিছু ভাবতে পারেন না। 

আপনি তাদের কাছাকাছি গিয়ে দেখেন, হুজুর বলে তারা আপনাকে তুচ্ছ নজরে দেখে না; বরং তারা আপনাকে মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধার নজরে দেখে। আমরাই ক্রমে ক্রমে তাদের মন থেকে সেই শ্রদ্ধাবোধটা মুছে ফেলি। সমাজে জেনারেল লাইনের লোক বলে কেউ নেই। সবাই মুসলিম। এই মুসলিমদের অনেক অধিকার আছে একজন আলেমের কাছে। তারা শুধু আপনার কাছে হুর-গিলমানের বয়ান শুনতে চায় না, তারা আপনাকে সকল ভালো কাজে তাদের পাশে দেখতে চায়। সবার পাশে দাঁড়ালেই সবাই আপনার কথা শুনবে। হুজুর আর জেনারেলের মাঝে এক নদী সমান দূরত্ব তৈরি হলে কে শুনবে কার কথা!

আমাদের একটা বড় সমস্যা। আমরা সাধারণের সঙ্গে মিশে সাধাণের রংয়ে রঙিন হয়ে যাই। সাধারণকে আমাদের রংয়ে রাঙাতে পারি না। যান, সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে তাদের ব্যথায় সমব্যথী হন, তাদের আনন্দে হাসুন। তাদের ভালো কাজগুলোতে অংশীদার হওয়ার চেষ্টা করুন। নিজে উদ্যোগী হয়ে ভালো কাজের উদ্যোগ নিন। জেনারেল তকমা দিয়ে তাদের পাপিষ্ঠ মনে করে দূরে সরিয়ে দেয়ার দ্বারা আল্লাহর কাছে অাপনার সম্মান মোটেও বাড়বে না। বরং মুসলিমের হক আদায় না করার আগুনে জ্বলতে হবে অযুত বছর।