‘রমজান-রামাদান’ বিতর্কের একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রতিফল আছে। সালাফি ঘরানার যারা এই প্রবণতায় আক্রান্ত, তারা আরবির প্রতি আকর্ষিত হয়ে এমন শুদ্ধ আরবির অনুশীলন-ব্যবহার শুরু করেছেন। কিন্তু বাংলা ভাষায় যখন আরেকটি ভাষার কোনো শব্দ অনুপ্রবেশ করে, স্বাভাবিকভাবেই সেটা বাংলাভাষার গতি-প্রকৃতি অনুসরণ করে নিজস্ব একটা রূপ দাঁড় করায়। এটা প্রত্যেক ভাষার নিজস্বতা। যেমন ইংরেজি Table (ট্যাবল) কে আমরা বলি টেবিল।

বহু শতাব্দী ধরে আরবিতে অনেক হিব্রু, ফার্সি, স্প্যানিশ শব্দ অনুপ্রবেশ করেছে। সেসবও কিন্তু আরবির গতি-প্রকৃতি অনুসরণ করে নিজস্ব ধরনে উচ্চারিত হয়ে আসছে। সেখানে মূল হিব্রু বা ল্যাটিনের স্বত্তাগত শব্দটি হুবহু উচ্চারিত না হয়ে আরবির প্রকৃতি অনুযায়ী নতুন গঠন ও উচ্চারণ তৈরি হয়েছে। যেমন স্প্যানিশ Constantinople (কনস্ট্যান্টিনোপল) আরবিতে অনুপ্রবেশ করেছে ‘কস্তুনতুনিয়া’ হয়ে। এটাই ভাষার সহজাত প্রক্রিয়া এবং ভাষা জন্ম নেবার পর থেকেই এ প্রক্রিয়া পৃথিবীর সর্বত্র শত শত শতাব্দী ধরে ঘটে আসছে। ভাষা প্রক্রিয়াজাতকরণের এই প্রক্রিয়া রোধ করার চেষ্টা করলে যেকোনো ভাষা তার নিজস্বতা হারাবে এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবে।

বাংলাভাষায় ব্যবহৃত আরবি বা বিদেশি শব্দকে যদি আপনি বাংলার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত হতে বাধা প্রদান করেন—এর ফলাফল হবে দু ধরনের। 
এক. বাংলাভাষার নিজস্বতা নষ্ট হয়ে ভাষাটা ধীরে ধীরে দেউলিয়া হতে পারে, তখন আপনার অবস্থা হবে না ঘর কা, না ঘাট কা। আপনাকে কথা বলতে হবে যাযাবর সম্প্রদায়ের মতো মিশ্র ভাষায়।

দুই. সাধারণ বাংলাভাষী মানুষের মনে ধর্মীয় কুলীন ভাষা ব্যবহারে প্রবল ভীতি তৈরি হবে। কেননা সমাজের ৯৫% মানুষ আরবি মাখরাজ জানে না। তারা মনে করবে, আরবি মানেই যেহেতু ধর্মীয় ভাষা, সুতরাং সঠিকভাবে উচ্চারণ না করলে গোনাহ হবে। এ কারণে তাদের ভেতর খুব স্বাভাবিকভাবেই আরবি-ভীতি প্রবল হবে এবং ‘তারাউইহ’ ‘স্বহীহ্’ বা ‘নাদাউই’র মতো মাখরাজধর্মী শব্দ উচ্চারণের প্রতি তাদের মনে অনীহা সৃষ্টি হবে। সম্ভবত এই ভীতি ইতোমধ্যেই জোরেশোরে শুরু হয়েছে। অনেকেই আরবিভাষা নিয়ে এমন গোঁড়ামি দেখে আরবি উচ্চারণে ইস্তফা দেয়া শুরু করেছে।

এখন একটা সম্পূরক কথা বলি। বাংলাদেশে ইসলাম আগমনের পর থেকে এ পর্যন্ত আরবি ভাষায় রচিত দশটি কিতাবের নাম বলুন তো! যেগুলো বাংলাদেশি কোনো স্কলার বাংলাদেশে থেকে আরবি ভাষায় রচনা করেছেন! দশটা আরবি কিতাবের নাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে নিঃসন্দেহে।

বিগত ১৩-১৪ শ বছরে এই দেশে আরব, পারস্য, হিন্দুস্তান থেকে শত সহস্র মুসলিম মনীষীর আগমন ঘটেছে। এই দেশে জন্ম নিয়ে প্রথিতযশা আলেম হয়েছেন—ইতিহাসে এমন ব্যক্তির উদাহরণও কম নয়। তারা ‘স্বহীহ’ আরবিতে কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি বা ‘স্বহীহ’ আরবিতে কথা বলেননি বলে এ দেশ থেকে ইসলাম হারিয়ে যায়নি। বরং বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে যারাই দাওয়াতের ব্রত নিয়ে এ দেশে এসেছেন, তারা কাল পরিক্রমায় এ দেশের মানুষের ভাষায় কথা বলেছেন। তাদের নিয়ে রচিত হয়েছে বড়জোর ফার্সি বয়েত, কিন্তু অঢেল লেখা হয়েছে বাংলা পুঁথি।

বঙ্গদেশে আগত বিখ্যাত প্রত্যেকজন মুসলিম সাধককে নিয়ে বাংলায় রচিত হয়েছে পুঁথিসাহিত্য। তাতে বাংলাদেশ থেকে ইসলাম বিদায় নিয়ে ইয়েমেন চলে যায়নি। বরং তারাই এসে বাংলার মাটি-বাতাস, জল-প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের একীভূত করে নিয়েছেন।

এ কারণেই বাংলাদেশের ইসলাম আর্মেনিয়া বা স্পেনের মতো নয়। স্পেনের ইসলাম ছিল শাসকগোষ্ঠীর ধর্ম। গ্রানাডা, কর্ডোভা, মালাগা, টলেডোর সাধারণ মানুষের মাঝে ইসলামকে তারা সার্বজনীন করতে পারেনি। সেখানে উমাইয়া প্রভাবিত শাসকদের প্রশাসনিক এবং দাপ্তরিক ভাষা ছিল আরবি। স্থানীয় স্প্যানিশ জনগণ ও ভাষার সঙ্গে শাসক ও ধনিক আরবীয় বংশোদ্ভূতরা একীভূত হতে পারেনি। ফলে ফার্ডিন্যান্ড ও ঈসাবেলার হাত ধরে স্প্যানিশ খ্রিষ্টীয় জাতীয়তাবাদের ধাক্কা যখন এসেছে, ইসলাম সেখান থেকে সমূলে উপড়ে চলে এসেছে।

একই কথা আর্মেনিয়া, আজারবাইজানের ক্ষেত্রেও।

আজকে যারা বাংলাভাষায় আরবি আধিপত্যবিস্তারের এমন প্রয়াস চালাচ্ছেন, তারা হয়তো বুঝতেও পারছেন না কী ক্ষতি তারা করে চলেছেন। তারা অতি ধার্মিকতার নামে বোকার মতো বাংলাভাষা থেকে ইসলামকে ক্রমশই দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন। ক্রমশই বাংলাভাষা এবং ইসলামের মধ্যে তৈরি করছেন দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর। একদিন দেখবেন, আপনি নিজেই আর এ প্রাচীর ভেদ করতে পারবেন না।