দ্রোহের স্মরণ
২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৭ সাল। ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লি।
সিপাহি বিদ্রোহ শেষ হয়ে গিয়েছে। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখল থেকে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে সিপাহি-জনতার সম্মিলিত যে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিলো তিন-চার মাস ধরে, চারদিন আগে ইংরেজদের দিল্লি পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে সে বিদ্রোহের ইতি ঘটেছে। যেসব সিপাহি, আলেম, সাধারণ জনতা এক হয়ে অস্ত্র ধরেছিলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে, তাদের অধিকাংশই হয়তো শহিদ হয়েছে নয়তো পালিয়ে গেছে দূর-দূরান্তে।

বিদ্রোহ শুরুর সময় পর্যন্ত দিল্লির নামমাত্র শাসক ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। তিনি ইংরেজদের ভয়-ভীতি দূরে সরিয়ে সিপাহি বিদ্রোহে মদদ দিয়েছিলেন বিদ্রোহী জনতাকে। যেসব সিপাহি অযোধ্যা, আম্বালা, কানপুর, বাঙ্গালা, ঝাঁসি, বহরমপুর, লাক্ষ্মৌ থেকে স্বাধীনতার আওয়াজ তুলেছিলো, তিনি তাদের সমর্থন দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে নিজেকে স্বাধীন সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসন হটিয়ে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষের আজাদির।

কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি অবশেষে। মাতৃভূমির প্রতি নিজেদের মমত্ববোধ ভুলে গিয়ে ভারতের মারাঠা, শিখ এবং আরও কয়েকটি জাতি ইংরেজদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। সামান্য অর্থ ও ক্ষমতার লোভে তারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয় ইংরেজদের হাতে। ফলশ্রুতিতে ইংরেজরা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জামসহ ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিকামী সিপাহি-জনতার ওপর। শুরু করে নির্মম গণহত্যা।

বিদ্রোহের মূল কেন্দ্র ছিলো রাজধানী দিল্লিতে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের শাহি প্রাসাদ লালকেল্লা। এখানেই একত্রিত হয়েছিলো সারা দেশের বিদ্রোহী নেতারা। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের অনেক শাহজাদা ছিলেন এ বিদ্রোহের অন্যতম সেনাপতি ও নেতা। সম্রাটের ২২জন ছেলের মধ্যে ১৮জনই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নেন এ আজাদি আন্দোলনে।

ইংরেজরা দিল্লি দখলের জন্য শহরজুড়ে গণহত্যা শুরু করার পর শহরের এমন কোনো রাস্তা ছিলো না যেখানে লাশ পাওয়া যায়নি। প্রতিটি রাস্তা, অলি-গলিতে কেবল লাশ আর লাশ। বিদ্রোহী সিপাহি তো বটেই, সাধারণ মানুষকেও তারা ছাড় দেয়নি। বিশেষত আলেম ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ছিলো তাদের প্রধান নিশানা। কেননা ইংরেজদের উৎখাত করতে দিল্লির আলেমরাই সিপাহি বিদ্রোহের সবচে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ কারণে ইংরেজদের আক্রোশ ছিলো মুসলিমদের প্রতি।

১৮ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ তারিখে পুরো শহর দখল করে ইংরেজরা লালকেল্লাও দখল করে নেয়। সেখান থেকে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে গ্রেফতার করে বাহাদুর শাহ জাফরের শাহজাদাদের, যারা তখনও যুদ্ধ করে যাচ্ছিলো ভারতের মুক্তির জন্য। লালকেল্লা থেকে শাহজাদাদের গ্রেফতার করলেও সম্রাটকে পাওয়া যায়নি লালকেল্লায়। সম্রাট লালকেল্লা থেকে পালিয়ে একটু দূরে অবস্থিত প্রয়াত সম্রাট হুমায়ুনের মাজারের একটি গোপন কুঠুরিতে আত্মগোপন করেন। সঙ্গে ছিলেন তার দুই স্ত্রী এবং এক শাহজাদা। ইচ্ছা ছিলো- কিছুদিন এখানে বন্দি থাকার পর পরিস্থিতি শান্ত হলে তিনি পালিয়ে লক্ষ্মৌ বা বাঙ্গালা যাবেন, সেখান থেকে আবার ঘোষণা দেবেন স্বাধীনতার।

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! ২০ সেপ্টেম্বর রাতে হুমায়ুনের মাজারের এক খাদেম অর্থের লোভে সম্রাটের অবস্থান ইংরেজদের জানিয়ে দেয়। ২১ সেপ্টেম্বর সকাল হতেই ইংরেজ ক্যাপ্টেন ডেভিস হাডসনের নেতৃত্বে কয়েকশো ইংরেজ ও মারাঠা সিপাহি পুরো মাজার ঘিরে ফেলে এবং সম্রাটকে বাইরে বেরিয়ে আসতে বলে। যদি বের হয়ে না আসে তাহলে নির্মমভাবে হত্যা করা হবে তার শাহজাদাদের।

বেদনার গল্প
: আপনি যাবেন না! ওরা আপনাকে দেখামাত্র গুলি করবে। সম্রাটের বেগম জিনাত মহল আবারও নিষেধ করলেন স¤্রাটকে। কোর্তার বোতাম লাগাতে গিয়ে থমকে গেলো সম্রাটের হাতের আঙুল। একবার তাকালেন জিনাত মহলের মুখের দিকে। গত কয়েকদিনের শোক আর শঙ্কা তার জ্বলজ্বলে মুখটাকে ভেঙেচুড়ে একাকার করে দিয়েছে। তিনি এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখলেন জিনাত মহলের।

: আমাকে যেতেই হবে জিনাত। আমরা ধরা পড়ে গেছি। শত্রুরা জেনে গেছে আমাদের অবস্থান। আমি যদি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ না করি তবে ইংরেজরা এখান থেকে অসম্মানের সঙ্গে টেনে হিঁচড়ে বের করবে আমাদের। আমি জীবিত থাকতে আমার পরিবারের কাউকে চোখের সামনে বেইজ্জতি হতে দেবো না। আমার ২২ ছেলের ১৮জনই হয়তো ওদের হাতে শহিদ হয়েছে নয়তো বন্দি হয়েছে। আমি আত্মসমর্পণ করলে ওদের হয়তো ছেড়ে দেবে। আমার জীবনদানে যদি ওদের জীবন বাঁচে… আমাকে আর নিষেধ করো না জিনাত! এই হিন্দুস্তানের জন্য তো কিছুই করতে পারিনি আমি। পরাধীন এক জীবন শুধু বয়ে বেড়িয়েছি। জীবনের শেষে এসে না হয় এই আত্মদান করে যাই। বিজেতা না হই, ইতিহাসে আমার নাম লেখা হোক শহিদ সম্রাট নামে।

সম্রাটের কথায় হু হু করে কেঁদে ফেললেন জিনাত মহল। সম্রাট সমস্ত শাহি লেহাজ ভুলে গিয়ে বাদশাহ হুমায়ুনের সমাধির এই গোপন কুঠুরিতে জড়িয়ে ধরলেন জিনাত মহলকে। একটু দূরে দাঁড়ানো আরেক বেগম আশরাফ মহলও নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। তিনিও হাউমাউ করে এগিয়ে এসে জাপটে ধরলেন বৃদ্ধ সম্রাটকে। কুঠুরির নির্মম দেয়াল কেবল গুমরে ওঠা কান্নার প্রতিধ্বনি দিয়েই সান্ত¡না দিতে পারলো।

এমন অভাবনীয় কান্নাভেজা ভালোবাসা সম্রাট তার অশতীপর জীবনে কোনোদিন পাননি। প্রাসাদ আর হেরেমের রুটিনবদ্ধ জীবন তাকে এমন বাঁধভাঙা কান্নার অশ্রুজল, এই বেদনামুখর বিচ্ছেদ উপহার দেয়নি কখনো। আহ! এমন বেদনায় ভেসে যদি আর ক’টা দিন বাঁচা যেতো! সম্রাটের হৃদয়ে বিরহ উপচে এলো।

একটু পর।
ইংরেজদের হাতে আত্মসমর্পণ করতে হুমায়ুনের সমাধিমহল থেকে বেরিয়ে এলেন ভারতবর্ষের শেষ মুঘলস¤্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। ভারতের স্বাধীনতার শেষ পরাধীন সূর্য। শেষ বিদ্রোহী সম্রাট। যার হাতে হাত রেখে ক’দিন আগেই অযোধ্যা, আম্বালা, কানপুর, বাঙ্গালা, ঝাঁসি, বহরমপুর, লাক্ষ্মৌর স্বাধীনতাকামী সিপাহিরা শ্লোগান তুলেছিলো- খালকে খোদা, মুলকে বাদশাহ, হুকুমে সিপাহি। আর তিনি নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন দিল্লির স্বাধীন সুলতান। তারপর সব ইতিহাস!

খুনের শহরে
: মিস্টার জাফর! আপনি আমাদের হাতে আত্মসমর্পণ করেছেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ। মুখে ক্রুর হাসি টেনে বললেন ইংরেজ ক্যাপ্টেন ডেভিস হাডসন। দিল্লির ইংরেজবাহিনীতে যাকে ‘চোখা কসাই’ বলে ডাকা হয়।

: আমার সঙ্গে এখন কী করা হবে? সম্রাট কোনো ধরনের সৌজন্যতা না দেখিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন। যে পরিস্থিতিতে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, তাতে সৌজন্যতা বলতে আর কিছু থাকে না। এখনও তিনি জানেন না গতকালের ধ্বংসযজ্ঞের পর কোথায় আছে তার সস্তানেরা। জামে মসজিদের চারপাশে, উর্দু বাজার, রোশনপুরা মালিওয়ারা, ছিপ্পিওয়াড়ার দিকে কাল পালিয়ে গিয়েছিলো তারা। সবাই কি ধরা পড়েছে? কী আচরণ করা হয়েছে তার জানবাজ সিপাহিদের সঙ্গে?

: আপনি কি দেখতে চান আপনার সঙ্গে কী করা হবে? সম্রাট তাকালেন ক্যাপ্টেন হাডসনের দিকে। ঠিক একজন কসাইয়ের মতোই লাগছে তাকে। লাল টকটকে হয়ে আছে তার চোখ মুখ। আবার হুঙ্কার ছাড়লেন ক্যাপ্টেন- সিপাহি! সম্রাটের উপহার নিয়ে আয়!
একটা গিলাফঢাকা তশতরি নিয়ে এগিয়ে এলো এক মারাঠা সিপাহি। মারাঠারা সবসময় সঙ্গ দিয়েছে ইংরেজদের। সিপাহি বিদ্রোহের পর দিল্লিতে ইংরেজদের আবার বিজয়ী করতে মারাঠাদের অবদান সবচে বেশি।

সিপাহি তশতরিটি রাখলো সম্রাট এবং ক্যাপ্টেনের পায়ের সামনে। ক্যাপ্টেন একটানে সরিয়ে ফেললেন তশতরি ঢেকে রাখা কালো রঙের গিলাফটি। গিলাফ সরাতেই সম্রাট দেখলেন তার আদরের তিন ছেলের কাটা মাথা সাজানো আছে তশতরিতে…।

রিক্তের বেদন
দিল্লির বিখ্যাত ইন্ডিয়া গেটের সামনে ‘খুনি দরজা’ নামে একটি দরজা আজও আছে। যেখানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় মির্জা মুঘল, মির্জা খিজির সুলতান, মির্জা আবু বকরসহ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের ১৮জন ছেলেকে। তাদের সঙ্গে অসংখ্য সিপাহি, আলেম, স্বাধীনতাকামী মানুষকেও নির্দয়ভাবে খুন করা হয়। পুরো লালকেল্লার আঙিনা, সামনের রাস্তা রক্তের নদী হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। সেই থেকে এই দরজার নাম হয়ে যায় ‘খুনি দরজা’।

এই ঘটনার পর ৮২ বছর বয়স্ক সম্রাট বাহাদুর শাহকে নির্বাসনে পাঠানো হয় তৎকালীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে। সেখানেই তিনি ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর ৮৭ বছর বয়সে অত্যন্ত নিগৃহীতভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে যে বাড়িতে রাখা হয়েছিলো, সে বাড়িরই পেছনে মামুলি একটা কবর খুঁড়ে তাকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরও ইংরেজরা কাউকে জানতে দেয়নি তার কবরটি ঠিক কোথায়। যাতে মানুষ তাদের সম্রাটকে শ্রদ্ধা জানাতে না পারে।

সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর অত্যন্ত উমদাহ কবি ছিলেন। উর্দুকবি গালিব ছিলেন তার দরবারি কবি। বেশ বন্ধুত্ব ছিলো দুজনের।
নির্বাসনের দিনগুলোতে সম্রাট অনেক কবিতা লিখেন। তার মধ্যে বিখ্যাত হলো, মৃত্যুর কয়েকদিন আগে লিখেছিলেন-
উমরে দারাজ মাঙ্গ কার লায়ি থি চার দিন
দো আরজু মে কাট গায়ে, দো ইস্তেজার মে
কিতনা হ্যায় বদনসিব জাফর, দাফন কে লিয়ে
দো গজ জমিন ভি না মিলি কোয়ে-ইয়ার মে

তরজমা
দীর্ঘ জীবন কামনা করে পেয়েছিলাম যে চারটে দিন
দু’দিন গিয়েছে প্রতীক্ষায় তার আর দু’দিন গেলো অপেক্ষায়
এমনই অভাগা এই জাফর, তাকে দাফনের জন্য
দু’ গজ জায়গা মেলেনি স্বজন-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ার কবরখানায়

ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধি আশির দশকে মায়ানমার সফরে গেলে তিনি যান বাদশাহ জাফরের মাজার পরিদর্শনে। সেখানে তিনি কবিসম্রাটের এই কবিতা পড়ে পরিদর্শন বইয়ে লিখেন-
‘দো গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে, পার তেরি কোরবানি সে উঠি আজাদি কি আওয়াজ, বদনসিব তু নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে, আজাদি কি পয়গাম সে।’

‘হিন্দুস্তানে তুমি দু’ গজ মাটি পাওনি সত্য, তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিলো একদিন। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার আগমনীধ্বনির মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।’


সিংহহৃদয় গ্রন্থ থেকে