‘নির্ভরযোগ্য সংবাদ’ খুব প্রয়োজনীয় একটা জিনিস এবং বলাই বাহুল্য, প্রয়োজনীয় জিনিস পরিমাণে খুব কম পাওয়া যায়। সংবাদের বেলায় এ কথা আরও কঠিনভাবে সত্য। সংবাদের নির্ভরযোগ্যতা না থাকলে সেটা আসলে সংবাদ হওয়ারই যোগ্যতা রাখে না। হয় সেটা মিথ্যা, নয়তো গুজব। এবং এ দুটোর প্রাচুর্য আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে মেলে: মিথ্যা সংবাদ এবং গুজব সংবাদ।

বাংলাদেশে সাধারণ সংবাদের নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে কেউ কেউ  প্রথম আলোসহ আর দুয়েকটি পত্রিকাকে মানদণ্ড ধরে থাকেন। কিন্তু ইসলামি সংবাদের বেলায় আমরা কাকে মানদণ্ড ধরবো? আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলাম বা মুসলিম সংক্রান্ত সংবাদের জন্য আল-জাজিরা টিভি চ্যানেল বা অনলাইনকে অনেকেই নির্ভরযোগ্য মনে করে থাকেন। কিন্তু আল-জাজিরা মোটের ওপর মুসলিম মানস ধারণ করলেও বিশ্বব্যাপী ইসলামি সংবাদ প্রচারের মাধ্যম নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট না হয় বাদই দেয়া গেল। তাহলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলাম ও মুসলিম সংক্রান্ত খবরে কোন সংবাদমাধ্যমকে নির্ভরযোগ্য ধরা হবে?

এই প্রশ্নটা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন যখন টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্র যা বলতো লোকজন সেটাই সত্য বলে ধরে নিতো। সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে এ সংবাদ! নির্ঘাত এটা সত্য না হয়েই পারে না- এমন বিশ্বাস ছিল মানুষের। এখন সেই বিশ্বাস নেই, অনেকাংশেই নেই। সাধারণ মানুষও জেনে গেছে, টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র, নিউজপোর্টাল বা অন্য যেকোনো সংবাদমাধ্যম বলতেই সত্য সংবাদ প্রচার করে না। মিথ্যা কিংবা বানানো সংবাদও তারা অবলীলায় প্রচার করে। সংবাদমাধ্যমের প্রতি মানুষের বিশ্বাস এখন তাই ভীষণ ঠুনকো হয়ে গেছে। এখন তারা সংবাদমাধ্যম হিসেবে সংবাদ দেখে না বা পড়ে না, তারা ‘ব্র্যান্ড’ দেখে সংবাদ পড়ে বা শুনে।

হ্যাঁ, সংবাদমাধ্যমও একটি বিরাট ব্র্যান্ড। যেমন ধরুন, অনেকেই হয়ত বাটা ছাড়া অন্য কোনো ব্র্যান্ডের জুতো পরবেন না। কেন? কারণ বাটার জুতোকে তারা টেকসই মনে করেন। তাদের ধারণা, বাটা কখনো চামড়ার কথা বলে র‌্যাক্সিনের জুতো বিক্রি করে না। দীর্ঘ অনেক বছর ধরে যাচাই করে তাই বাটার ওপর তারা আস্থাশীল। একই কথা সংবাদমাধ্যমের বেলায়ও সত্য। আল-জাজিরা ১২ বছর ধরে সত্য সংবাদ প্রচার করে মুসলিমবিশ্বের আস্থা অর্জন করেছে, আবার অনেকের ধারণা অনুযয়ী পেশাদারি মনোভাবে ২০ বছর ধরে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করে প্রথম আলো  একটা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। তাই এখন তারা প্রথম আলোর সংবাদের ওপর চোখ বুজে বিশ্বাস করেন, অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমকে করেন বা না করেন।

এটা হলো সংবাদমাধ্যমের ব্র্যান্ডিং, নির্ভরযোগ্যতা। ব্র্যান্ড কখনো এক দিনে দাঁড়ায় না। দীর্ঘদিনের পেশাদারিত্ব, বস্তুনিষ্ঠতা, পণ্যের মানের ব্যাপারে আপোসহীনতা, ভোক্তাশ্রেণির আগ্রহকে মূল্যায়ন করা -এসবের সমষ্টিতে একটি পণ্য বা প্রতিষ্ঠান ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সংবাদও একটি পণ্য। আপনি এটাকে কীভাবে পাঠকের সামনে পেশ করছেন, সে হিসেবে এটার ব্র্যান্ড মূল্য নির্ধারণ হবে।

বাংলাদেশে ইসলাম সম্পর্কিত যে কয়েকটা সংবাদমাধ্যম কাজ করছে, কোনোভাবেই তাদেরকে সংবাদের ব্র্যান্ডিং বিষয়ে আন্তরিক বলে মনে হয় না। তারা যে সংবাদ প্রচার করছে সেটা সত্য না মিথ্যা, কিংবা তাদের সংবাদমাধ্যম সবসময় নির্ভরযোগ্য সংবাদ প্রচার করে – এমন বিশ্বাস এখনো পাঠকের মনে তুষ্টি অর্জন করতে পারেনি। এটা একটা হতাশাজনক অভিজ্ঞতা।

অঢেল সংবাদের জন্য ইসলামি পাঠকরা লালায়িত নয়। রাজনীতি, সমাজচিত্র, আন্তর্জাতিক বিষয়ের সংবাদের জন্য পাঠক ইসলামি পোর্টালের দ্বারস্থ হয় না। এখানে তাদের আগ্রহ ইসলাম সম্পর্কিত সংবাদে। হোক সেটা জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক। এবং মনে রাখা প্রয়োজন, পাঠক অবশ্যই আপনার কাছে সঠিক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটি আশা করে। সংবাদের বাহুল্য বা সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব মতামত নয়, পাঠক ঘটনার সত্যতা কামনা করে। প্রত্যেক পাঠকেরই নিজস্ব মতামত ভিন্ন, সেখানে সংবাদ নিজেই যদি একটা মতামত পেশ করে তাহলে সংবাদ এবং পাঠকের মধ্যে অনেক সময় সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। সংবাদমাধ্যম তখন পাঠকপ্রিয়তা হারাতে থাকে।

সংবাদমাধ্যম যদি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কথা ভেবে সংবাদ প্রচার করে, তবে সে সংবাদমাধ্যম কখনো ব্র্যান্ড বা নির্ভরযোগ্য বলে দাঁড়াতে পারবে না। তাকে চিন্তা করতে হবে বাংলাভাষী ২০ কোটি মুসলিমের কথা। আপনি যখন ২০ কোটি মুসলিমের কথা ভেবে ৩০০ শব্দের একটি সংবাদ প্রচার করবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে সংবাদের তথ্য, ভাষা, উপাত্ত সার্বজনীন হতে বাধ্য। সংবাদের চেহারাই তখন পাল্টে যাবে। কিন্তু যখন এ সংবাদটি নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর কথা ভেবে লেখা হবে তখন এর তথ্য, ভাষা, উপযোগিতা হয়ে যাবে নড়বড়ে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এ সংবাদমাধ্যমের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে দ্রুত।

পাঠককে তৈরি করতে হয়। পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী যদি সংবাদ তৈরি হয় তাহলে সে সংবাদ কখনোই গ্রহণযোগ্যতার মানদন্ডে উন্নীত হতে পারবে না, ব্র্যান্ড বা নির্ভরযোগ্যতা তো দূরের বিষয়। দিনে দুটো সংবাদ বা প্রতিবেদন হোক, কিন্তু সে দুটো প্রতিবেদনে ২০ কোটি মুসলিমের মনোচাহিদা যেন প্রতিফলিত হয়। অজস্র সংবাদ বা প্রতিবেদন কেউ ইসলাম সম্পর্কিত ওয়েবসাইটের কাছে কামনা করে না। তারা সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি বা দুটো প্রতিবেদন প্রকাশ করুক, যেগুলো তাদের পাঠচাহিদাকে সুসংহত ও তুষ্ট করবে।

এভাবে মাসে ৩০টি প্রতিবেদন এবং বছরে সাড়ে তিন শ প্রতিবেদন যখন কোনো সংবাদমাধ্যম পরিবেশন করতে পারবে, খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মাঝে তাদের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্যতা সৃষ্টি হবে, মানুষের মনে তাদের ব্র্যান্ড তৈরি হবে। সময় লাগবে, শ্রম লাগবে, ঠুনকো জনপ্রিয়তাকে জলাঞ্জলি দেয়ার মতো সৎসাহস লাগবে, কিন্তু যখন আপনার সংবাদমাধ্যম ব্র্যান্ডে পরিণত হবে তখন ২০ কোটি মুসলিমের ভরসার জায়গা হবে এটি। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর চেয়ে ২০ কোটি মানুষের ভালোবাসার দায় অনেক অনেক বেশি।

ইসলাম টাইমস তার পথচলার এক বছর পূরণ করল। এটা অবশ্যই আশাবাদের সংবাদ। আশা করি, ভবিষ্যতে তারা বাংলভাষাভাষী মানুষের ভরসার জায়গা হয়ে উঠবে। শুভকামনা সবসময়।