২৮ মে ২০২০ তারিখের প্রথম আলোর প্রতিবেদনটা আপনাদের নজরে পড়েছে কি-না জানি না। প্রতিবেদনের শিরোনামটি ছিল এমন—‘১০ বছরে ধনী বাড়ার হারে শীর্ষে বাংলাদেশ’। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ১০ বছরে পৃথিবীর মধ্যে সবচে বেশি ধনী বেড়েছে বাংলাদেশে। বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স (www.wealthx.com) সম্প্রতি গত এক দশকে বিশ্বের ধনী জনগোষ্ঠীর সম্পদ পর্যালোচনা ও সামনের ১০ বছরের সম্পদ বণ্টন কেমন হবে, তার ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছে। সেই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে প্রথম আলো প্রতিবেদনটি সাজিয়েছে। প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান ছকও উল্লেখ করা হয়েছে। ছকে দেখা যাচ্ছে, ধনী বৃদ্ধির আনুপাতিক হারে বাংলাদেশ পেছনে ফেলে দিয়েছে আমেরিকা, চায়না, জাপানসহ ইউরোপ-আমেরিকার সকল দেশকে।

গত ১০ বছরে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে শহর-নগরে দৃশ্যমান ঠিক কী পরিমাণ উন্নয়ন ঘটেছে, সে ব্যাপারে সঠিক সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান আমার জানা নেই। তবে গত ১০ বছর রাজধানী ঢাকায় বসবাসের সুবাদে দৃশ্যমান তেমন কোনো উন্নয়ন আমার চোখে পড়েনি। বরং বহুবিধ ভোগান্তি যে বেড়েছে এ ব্যাপারে আমি সাক্ষ্য দিতে পারব। তাহলে ‘ধনী বাড়ার হারে শীর্ষে বাংলাদেশ’ হওয়ার দ্বারা রাষ্ট্র বা জনগণের ফায়দাটা কোন দিক দিয়ে হলো?

এখানে মূল যে ফ্যাক্ট আপনাকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশে ধনীর পরিমাণ বাড়ছে—এ কথা সত্য। কিন্তু ধনী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধনীদের সম্পদের সুষম বণ্টন হচ্ছে না। ধনীরা নানা ব্যবসা বাগিয়ে কোটি কোটি ডলার আয় করছে—ঠিক। কিন্তু তাদের সেই আয়ের সঠিক আয়কর এবং অন্যান্য ট্যাক্স তারা আদায় করছে না। বরং এসব কর ও ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য তারা সরকারের উচ্চপদস্থ নেতা এবং রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কোটি টাকা উৎকোচ দিচ্ছে। অথবা ব্যবসায়িক নানা ধরনের সুবিধা আদায়ের জন্যও তারা এই দুই শ্রেণির ব্যক্তিদের বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করে থাকে। উৎকোচ গ্রহণকারী এসব দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি সেই টাকা আবার বিনিয়োগ করছে দুই নম্বরি ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন লাভজনক ব্যবসায়িক কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে। ফলে দেখা যাচ্ছে, ধনীর টাকা ঘুরেফিরে আবার ধনীর হাতেই যাচ্ছে। এতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানে তেমন কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দরিদ্রের আয় ধনীর মতো পাল্লা দিয়ে বাড়েনি। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দরিদ্র এবং প্রায় ২ কোটি মানুষ অতিদরিদ্র।’

এই যে আমাদের মতো প্রায় ৬ কোটি দরিদ্র মানুষ, ঘূর্ণিঝড়ে নদীর বাঁধ ভেঙে যাদের বাড়িঘর পানির তোড়ে তলিয়ে যায়, বৈশাখী ঝড়ে যাদের ধানক্ষেত উজাড় হয়ে যায়, করোনা হলে যাদের লাশ রাস্তায় বেওয়ারিশ পড়ে থাকে, তিন-চার বছর ধরে যারা মেট্রোরেলের স্বপ্নের নিচে চাপা পড়ে চরম ভোগান্তিতে দিনযাপন করছে, পেঁয়াজের দাম বাড়লে বাজারের ব্যাগ হাতে বাজারে যেতে ভয় পায়—এই কোটি কোটি ‘ম্যাঙ্গো পিপল’ আমরা আসলে রাষ্ট্র ও সরকারের চোখে কী? এই রাষ্ট্রের জনগণ? নাকি ধনিকশ্রেণির টাকা বানানোর মেশিন?

এত এত ধনী মানুষের আবাদ হচ্ছে এ দেশে অথচ সেই ধনীরা রাষ্ট্রের আয়কর দেয় না, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স প্রদান করে না, সরকারি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোন নিয়ে মেরে দেয়। এগুলো কী? মগের মুল্লুক? এগুলো কার টাকা, সরকারের বাপের? এগুলো আমাদের টাকা, জনগণের পাওনা টাকা, আমাদের মতো দরিদ্রপীড়িত, ‘উন্নয়নের’ যাঁতাকলে পিষ্ট হাভাতে বাঙালির কষ্টের টাকা।

এই নব্য মিলয়নিয়ার ধনিকশ্রেণিকে সরকার বা রাষ্ট্র কিছুই বলতে পারবে না। রাষ্ট্র তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আছে। রাষ্ট্র আর ধনিকশ্রেণি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তারা এক মায়ের পেটের আপন মাসতুতো ভাই। একজন আরেকজনের গায়ে হাত তুলবে না কখনো।

কিন্তু আপনি-আমি কী করছি? আমরাও কি এভাবে দারিদ্রতার ‘বরমাল্য’ গলায় পরে এসব দেখেই জীবন পার করে দেবো? অর্থনৈতিক যে জুলুমের শিকার আমরা হচ্ছি প্রতিনিয়ত, সেই জলজ্যান্ত চাক্ষুষ জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলার দায়িত্ব আপনারও। জুলুমের বিরুদ্ধে কোটি কোটি মজলুম মানুষের পক্ষে সত্য উচ্চারণ না করলে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার সার্থকতাই বা কি!